ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনও ইউরোপের নির্ভরশীল অংশীদার নয় ॥ মেরকেল

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা নেই

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ৩০ মে ২০১৭

যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা নেই

জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেল সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রেক্সিটের পর বিভক্ত ব্রিটেন এখন আর ইউরোপের নির্ভরশীল অংশীদার নয়। মিউনিখে একটি নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় তিনি একথা বলেন। মেরকেল বলেন, দুটো দেশের সঙ্গেই তিনি ভাল সম্পর্ক চান, তবে ইউরোপের ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরই লড়াই করতে হবে। ইউরোপীয়দের ভবিষ্যত নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার বিষয়ে মেরকেল যখন বক্তব্য দেন, তখন তার হাজার-হাজার সমর্থক করতালিতে ফেটে পড়ে। তিনি বলেন, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখলেও তাদের ওপর আর আস্থা রাখা যায় না। সিসিলিতে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন সম্মেলনকে তিনি ‘খুব কঠিন’ এবং ‘খুবই অসন্তোষজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেন। জার্মান চ্যান্সেলর বলেন, যখন আমরা অন্যদের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারতাম, সেই সময় পেরিয়ে গেছে। গত কয়েকদিনে আমি তা বুঝতে পেরেছি। সেজন্যই আমি বলছি, ইউরোপিয়ানদের ভবিষ্যত নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও আমরা বন্ধুত্ব চাই, কিন্তু ভবিষ্যতের লড়াই আমাদেরই করতে হবে। আপনাদের সঙ্গে আমি সেটাই করতে চাই। জি-সেভেন সম্মেলনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বিষয়ে সমর্থন জানাতে অস্বীকৃতি জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপরই দেশে ফিরে মেরকেল এমন মন্তব্য করলেন। ছয়টি দেশ এতে সম্মত হলেও ট্রাম্প বলেন, তিনি দেশে ফিরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। ব্রাসেলসে ন্যাটোর সম্মেলনেও তিনি ইউরোপের নিরাপত্তা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত না করে বরং সদস্য দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা খাতে আরও ব্যয় বাড়াতে বলেন। বিবিসির ইউরোপ সম্পাদক কাটিয়া এ্যাডলার বলেন, মূলত জার্মান ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই মেরকেল এসব কথা বলছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের জনমত জরিপে মেরকেল এগিয়ে রয়েছেন। নির্বাচিত হলে তিনি চতুর্থবারের মত চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করবেন। এ্যাঞ্জেলা মেরকেল গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কলহপূর্ণ বৈঠকের পর রবিবার মার্কিন ইউরোপ সম্পর্কের এক নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আর তাহলো ‘ইউরোপকে নিজের ভাগ্য নিজেকেই নির্ধারণ করতে হবে।’ ট্রাম্পের ইউরোপ সফরের পর এ্যাঞ্জেলা মেরকেলের এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে দুই মহাদেশের এতদিনের ঐক্যের মাঝে বড় ধরনের ভাঙ্গনের সুর দৃশ্যমান হলো এবং এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা খাত ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি প্রকাশ্য রূপ নিল। অবশ্য মেরকেলের এই উপলব্ধি দেরিতে হলেও অনভিপ্রেত ছিল না। কেননা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে সৌদি আরবের শাসক ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নেতাদের যাদের অনেকেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নন সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করেছেন ঠিক তার বিপরীত ঘটনা ঘটিয়েছেন ইউরোপ সফরে গিয়ে। এখানে তিনি জার্মানির ব্যবসায়িক নীতিকে ক্লোজডোর হিসেবে সমালোচনা করে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি ন্যাটো জোটভুক্ত ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ না দেয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে ট্রাম্প ৭-জাতি সম্মেলনে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানান, ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের প্রস্তুতি এবং ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় জোটের বিরুদ্ধে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে মেরকেলের এই কঠিন মন্তব্য। ইউরোপের কার্যত প্রধান নেত্রী এ্যাঞ্জেলা মেরকেলের এই একলা চলো নীতি ও স্বনির্ভরতা অর্জনের ঘোষণা রাজনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে নানারূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে জার্মানির রোজেন বার্গ ইউনিভার্সিটির স্টিফেন বিয়ার্লিং বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বারা অভিন্ন মূল্যবোধের বিশ্বাস দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে শীর্ষস্থানীয় দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিধান সম্ভব নয়Ñএই ধারণা ট্রাম্পের মন-মানসিকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং ব্রাসেলস ও ৭-জাতি সম্মেলনে তার কথাবার্তা ও শারীরিক ভাষায় এসবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইউরেশিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান ক্লিফ কাপচ্যান বলেন, ইউরোপ সফরকালে তার আচরণ ইউরোপীয় নেতাদের মাঝে যে ক্ষত তৈরি করেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হতে পারে। এক ই-মেইলে কাপচ্যান বলেন, ইরাক যুদ্ধ পরবর্তী এবং এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ট্রান্স আটলান্টিক অঞ্চলে সম্পর্কের সবচেয়ে বড় ভাঙ্গন হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং যদি ইরানের পারমাণবিক চুক্তি তালগোল পাকিয়ে যায়, তবে উদ্ভূত সঙ্কটে ট্রাম্প ইউরোপকে তার পাশে পাবে না। উইকলি স্ট্যান্ডার্ড ম্যাগাজিনের সম্পাদক উইলিয়াম ক্রিপ্টল এক টুইটারে বলেছেন, আজ এ্যাঞ্জেলা মেরকেলের মন্তব্য এক স্মারকবার্তা হিসেবে ধরে নেয়া হলে, ট্রাম্পের ব্যর্থতা, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমেরিকার ব্যর্থতা এবং তা আমেরিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এদিকে বিপুল ভোটে জয়ী ফ্রান্সের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ চ্যান্সেলর মেরকেলে সঙ্গে ‘ফ্রাঙ্কো-জার্মান’ সহযোগিতার আলোকে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। -বিবিসি ও ওয়াশিংটন পোস্ট।
×