ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল মিডলক্লাস!

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ৩০ মে ২০১৭

মতিলাল মিডলক্লাস!

মতিবাবু মিডলক্লাস। পপুলার বয়ানে মধ্যবিত্ত। এদের প্রবলেমের শেষ নেই, চিন্তার অবধি নেই। এই শ্রেণীর মানুষের জীবনে নেই- এর প্রভাবটা একটু বেশিই বোধ হয়! মতিবাবুকে যদি এদের প্রতিভূ হিসেবে ধরা যায়, তাহলে দেখবেন মধ্যবিত্তের কাজ কারবার খানিক অদ্ভুতুড়ে। কিছুতেই এরা শান্তি পায় না। এরা চেয়ে কিছু না পেলে অসুখী, আবার পেলেও এরা খেতে চায়, কিন্তু খেয়ে পরিতৃপ্ত নয়। ভাল কিছু করতে চায়, কিন্তু পারে না। কারণ অন্যরা তাকে টেনে ধরে। এর নাম কাঁকড়ানীতি। গেলে সদলবলে, নইলে না। তুমি উঠতে চাইলেও বা উঠতে দিচ্ছে কে! বাকিরা টেনে ধরবে না! বলাবাহুল্য, এই দলে দলাদলি ও নিন্দুকের বড় প্রাদুর্ভাব। ভাল কাজে কোন তালি পাবেন না, জুটবে শুধু গালি। আবার যদি ধরুন কোন রকম খুঁত খুঁজে না পায়, তখন তেঁতুলসুরে বলে, অত ভাল ভাল নয়, বুঝলে! এহেন মতিবাবু স্ত্রীকে নিয়েও খুব একটা তৃপ্ত নন। বরং প্রায়শ তার মনে হয়, বিয়ে-টিয়ে না করে বরং ছাড়া গরুর মতো ঘুরে-ফিরে খেলে ঘাড়ে-গর্দানে ভাল থাকতেন। কথা একেবারে মিছে নয়। ইদানীং স্ত্রীরা সব ব্যাপারে নাক গলায়, যখন-তখন কড়া অনুশাসন জারি করে। মনে হয় যে, ও বস্তু থাকার চেয়ে না-থাকাই বরং ভাল। এই থাকা না থাকার টানাপড়েনে বেচারা মতির বাবুত্ব ঘুচে গিয়ে যেটুকু বাকি আছে তাতে তাকে আর ‘মানুষ’ বলে চেনা যায় না। মতিলাল স্রেফ মধ্যবিত্ত। সেদিন হলো কি, মতিবাবুর মন ও মতি দুটোকে কিঞ্চিত খুশি করার জন্য তার স্ত্রী ভাল-মন্দ কিছু রান্না করলেন। মতি মুখে দিয়ে রেসিপির তফাৎ বুঝতে পেরেই দেন চিলচিৎকার। একি! এসব কী রেঁধেছ? মতিবাবুর স্ত্রী ভয়ে আতঙ্কে প্রমাদ গোনেন। না জানি আবার কী হলো! মতিবাবু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, বলি এত খাসা পদ রাঁধার কী দরকার ছিল! এর পেছনে তেল-নুন-ঘি কম ঠেসেছ! জান না, ডাক্তার আমাকে কী এ্যাডভাইস করেছে! বিস্বাদ ইজ দ্য বেস্ট! জিভে স্বাদ আনে এমন কিছুই খাওয়া যাবে না। সব ভুলে বসে আছ তুমি! নাকি চাও, বেশিদিন আর ধরাধামে না থাকি। তোমার মতলবখানা কী বল তো খোলাসা করে! মতিবাবু চেঁচান। দাঁতমুখ খিঁচান। ভাল রান্না তার ভাল লাগে না। পদে বৈচিত্র্য এলে স্ত্রী বেশি খরুচে হয়ে গেছে বলে সন্ত্রস্ত হন। ওদিকে দুএক পদে আবার তার মনও ওঠে না। অবশ্য ‘খাসা রান্না’য় মতিবাবুর অরুচির একখানা জবরদস্ত কারণও আছে। গেলহপ্তায় পৈটিক গোলযোগের কারণে তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ভাবলেন, গ্যাসজনিত মামুলি ব্যথা হবে হয় তো। দুটো গ্যাসের গুলি গিলে খেলেই সেরে যাবে। কিন্তু গেল না, ব্যথা বরং ক্রমশ গতিপ্রাপ্ত হয়, পেট ছেড়ে এবার বুকে এসে বাসা বাঁধে। ‘মধ্যবিত্তিক’ ব্যাপার কিনা! ডাক্তার মওকা বুঝে তার যাবতীয় জ্ঞানের ঝাঁপি খুলে বসেন। এমন জবরদস্ত রোগী তিনি আর পাননি। ব্যথা কী জিনিস, কত প্রকার, ব্যথা কেন হয়, ব্যথা থাকা কেন দরকার, না থাকলে জীবনটা কেমন দরকচা মেরে যেত- ইত্যাকার সব দার্শনিক বিষয়ে তার বিস্তর পড়াশোনা। মতিবাবুর মনে হলো লোকটা ডাক্তার না হয়ে বরং মোক্তার বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে ভাল ছিল। যেন তামাম জনতার যাবতীয় জ্ঞান প্রদানের ইজারা নিয়ে বসে আছেন তিনি। একে নিয়ে সফদার ডাক্তারের চেয়েও অতি উত্তম রকমের ছড়া বাঁধা যায়! স্যার, ব্যথার কীভাবে উপশম হয় বলুন? মিনতির সুরে বলেন মতিলাল। আহা, অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! বলছি তো একটু ধৈর্য ধরুন। ডাক্তার সাহেব খসখস করে টেস্টের এক বিশাল চোথা ধরিয়ে দিলেন। এটা কি? মতিবাবু তাজ্জব। ওষুধের নাম বলে তো মনে হয় না। এগুলো করাতে হবে। ডাক্তার ছোট্ট করে মাথা নাড়েন। কী করাতে হবে! ব্যথা কবে সারবে? সারবে। ব্যথাকে একটু সময় দিন। বলেছি তো, জীবনে ব্যথাবেদনা থাকাটা খুব জরুরী। নইলে বেঁচে আছেন যে, সেটা বুঝবেন কী করে! মতিবাবু বুঝলেন, এর মাথায় বড় কোন গ-গোল আছে। নইলে সামান্য ব্যথা সারাতে মোট চোদ্দখানা টেস্ট কেন দেবেন! ব্যথাটা সামান্য কি গুরুতর সে সিদ্ধান্ত দেবার তুমি কে হে মতিবাবু! সবখানে একলাইন বেশি বোঝাটা নিদারুণ বেয়াদবি। বুকের বেদনা নিয়ে বারফট্টাই মোটেও ভাল কথা নয়। টেস্টের চোথা নিয়ে বাসায় ফিরেই গিন্নির মরাকান্না শুনতে পান মতিলাল। ওগো শুনছো, গ্যাসের দাম আরেক দফা বেড়েছে। ডাবল বার্নার এখন দুই শ’ টাকা বেশি। কিন্তু বেতন তো বাড়েনি। তার মানে সরকারী গ্যাস আর সিলিন্ডার এখন প্রায় সমান সমান। মতিলাল বুঝমান মানুষ। তিনি চক্রান্তের গন্ধ পান। গ্যাসের এই যে পৌনঃপুনিক মূল্যবৃদ্ধি- এতে বেনিফিসিয়ারি কে বল তো গিন্নি? মিটিমিটি হেসে শুধান মতিলাল। গিন্নি কর্তার হাসির মাজেজা ধরতে না পেরে চুপ থাকেন। মতিলাল স্বগতোক্তি করেন- লাভের গুড় খাবে সিলিন্ডারমালিক। বুঝলে গিন্নি, আমার বুকের ব্যথা আর সারবে না। টেস্টফেস্ট করিয়ে কী হবে বল! যিনি বাঁচাবেন তিনিই যদি জানে মারেন- বার বার চুলোর দাম বাড়ান, তাহলে অসুখের আর দোষ কী! মতি ভাবলেন, বার্নার একটা কমিয়ে নেবেন। গিন্নি সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, তাতে কী লাভ? মাত্র তো দেড় শ’ টাকা কম। কিন্তু রান্নার ঝক্কি অনেক। তার মানে বাহাদুর বেশ বুঝেশুনেই গ্যাস নিয়ে কলকব্জা নেড়েছেন। এলএনজিমালিকের নির্ঘাত পোয়াবারো। তার চেয়ে বরং গ্যাসে মিটার বসালে ভাল হতো। তাতে সরকার ও সিটিজেন উভয়েই বাঁচত। অনেক ভেবেচিন্তে শেষে উপায় একটা বের করলেন মতিলাল। গিন্নিকে ডেকে মিঠেসুরে বললেন, বুঝলে ওই টেকো ডাক্তারের কথাই ঠিক। জীবনটাকে একটু ছেঁটে দিতে হবে। বেঁচে থাকাটা জরুরী, সাধ-আহ্লাদ নয়। ছেঁটে দেবে মানে! জীবন কি বাগানের গাছ যে ছাঁটবে! গিন্নি হতাশ। তা কী করবে শুনি? মধ্যবিত্তের জীবন যেমন হয়- খাদ্য বলতে স্রেফ ভর্তাভাজি আর বাহুল্যবর্জিত দিনগুলজার। আমাদের কোন চুলোই থাকবে না। চেলাকাঠ দিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভর্তাভাত নামাতে পারবে না তুমি! বড় আশা নিয়ে গিন্নির দিকে তাকান মতিলাল। গিন্নি যা বোঝার বুঝে গেছেন। এর নাম সমঝোতা। সময়ের সঙ্গে তালঠোকা। বাঁশই যদি না থাকে তো বাজবে না বাঁশি, রাগিনীরও দরকার পড়বে না। এক টুকরো কাঁথা-ডানে-বাঁয়ে কতদিক ঢাকবে বল! গিন্নি কিছু না বলে গোপনে দীর্ঘশ^াস ছাড়েন। বুকের ব্যথাটা একটু থিতিয়ে এলো যেন মতিলালের। এভাবেই কেটে যায় মধ্যবিত্তের বর্ণহীন ফ্যাকাসে জীবন। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×