ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভর্তিচ্ছুদের স্বপ্নের দশ কলেজের শীর্ষে রাজউক উত্তরা মডেল

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩০ মে ২০১৭

ভর্তিচ্ছুদের স্বপ্নের দশ কলেজের শীর্ষে রাজউক উত্তরা মডেল

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কলেজ পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আসলে কোনটি? কোন কোন কলেজে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে চায় সবচেয়ে বেশি? অভিভাবকরাই বা সন্তানের জন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন? শিক্ষা নিয়ে বহুদিনের এসব প্রশ্নের উত্তর মিলল এবারের অনলাইন ও কলেজে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়াতেই। কলেজ ভর্তিচ্ছু সোয়া ১৩ লাখ শিক্ষার্থীর আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ হচ্ছে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর পছন্দের প্রতিষ্ঠান। যেখানে এক হাজার ৬৩৪ আসনের জন্য আবেদন করেছেন ৪২ হাজার ৬৪৫ শিক্ষার্থী। প্রায় একই চিত্র শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষ তালিকায় থাকা কলেজগুলোরও। এদিকে ৪২ হাজার পর্যন্ত আবেদন পাওয়া কলেজ যেমন আছে, তেমনি শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই পছন্দ করছে না দেশে এমন কলেজও আছে। দেশের অলিতে গলিতে মানহীন নামসর্বস্ব কলেজের গজিয়ে ওঠার একটি চিত্রও পাওয়া গেছে কলেজ ভর্তির আবেদনে। সেরা কলেজগুলোতে যেখানে ২৫ হাজার থেকে ৪২ হাজার পর্যন্ত আবেদন পড়েছে. সেখানে একজন শিক্ষার্থীও ভর্তির জন্য আবেদন করেনি এমন প্রতিষ্ঠানও আছে ছয়টি। ১০ জনের বেশি আবেদন করেনি এমন কলেজ ও আলিম মাদ্রাসা আছে ১৫৪। শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, ভর্তি আবেদনের চিত্রই বলে দিচ্ছে, একদিকে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীই পাচ্ছে না। সারাদেশের একাদশ শ্রেণীতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পছন্দ অনুসারে শীর্ষ ২০টি কলেজের অধিকাংশই রাজধানীতে। সেরা দশটির মধ্যে আটটি আছে রাজধানীতে আর বাইরে দুটি। তবে সংখ্যায় কম হলেও রাজধানীর বাইরের প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষ ১০ কলেজের তালিকায় উঠে আসার ঘটনাকে আশাব্যঞ্জক বলে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদরা। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশের ১০ কলেজে আসন আছে মাত্র ১৬ হাজার ২৬৩। অথচ এখানে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৩০ হাজার ৯৪১ এসএসসি পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থী। একদিকে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়া, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী না পাওয়া প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামূল কবীর বলছিলেন, এটা একটা বাস্তবতা যে সারা দেশে এখনও ভাল প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে অবশ্য সরকার চেষ্টা করছে। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার মান বাড়ানোর প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে। তবে শিক্ষক প্রশিক্ষণের দিকে নজর দেয়া দরকার। প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়ানো দরকার, অবকাঠামোও তৈরি করে দেয়া জরুরী। এমন করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা হাতেগোনা কয়েকটি কলেজের দিকে তাকিয়ে না থাকেন। অভিভাবকরাও যেন আস্থা পান অনেক কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে। এদিকে পছন্দের কলেজে ভর্তির চিন্তায় এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের চোখে ঘুম নেই। উদ্বিগ্ন তাদের অভিভাবকরাও। বিশেষ করে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সংকট তুলনামূলক বেশি। ভাল ফলের তুলনায় মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে আসন সঙ্কট নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, এটা তো বাস্তবতা, সবাই হয়ত তার পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। তবে কেউই ভর্তিবঞ্চিত হবে না, এটাও আমাদের চেষ্টার একটি বিশেষ দিক। তিনি আরও বলেন, ভর্তির ক্ষেত্রে কোন আসন সমস্যা নেই। তবে ভালমানের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম। এ কারণে ভাল ফলধারীদের ভর্তির জন্য বেশি প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতা হবে আরও বেশি। কেননা যারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, তারা সাধারণত ল্যাবরেটরি ও ভাল-দক্ষ শিক্ষক আছেন এমন প্রতিষ্ঠানে এইচএসসি পড়তে চায়। তাই এসএসসি পাসের পর মফস্বলের অনেকেই ঢাকাসহ শহরমুখী হয়। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকা রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের পর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা সিটি কলেজ। এখানে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ৩৯ হাজার ৩১৬, যেখানে আসন আছে তিন হাজার ৪৫০। তৃতীয় অবস্থানে আছে মিরপুর সরকারী বাঙলা কলেজ। যেখানে এক হাজার ৭০০ আসনের বিপরীতে আবেদন করেছেন ৩৯ হাজার ৫২ শিক্ষার্থী। চতুর্থ অবস্থানে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, যেখানে আবেদন পড়েছে ৩৬ হাজার ৭৭৭, আসন আছে দুই হাজার ২০০। কবি নজরুল সরকারী কলেজে আবেদন করেছেন ৩৫ হাজার ৫৭১, আসন আছে এক হাজার ৬০০। ময়মনসিংহের সরকারী আনন্দ মোহন কলেজের অবস্থার এরপরই। যেখানে আবেদন করেছেন ৩৪ হাজার ৮৯৮, আসন আছে ৯০০। এর পরের অবস্থান একই এলাকার শহীদ নজরুল ইসলাম কলেজের। যেখানে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ২৬ হাজার ৪৫২, আসন আছে এক হাজার ৩২৫। এরপর সাত নম্বরে আছে রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ। এখানে আবেদন করেছেন ২৫ হাজার ৬৪৪, আসন আছে এক হাজার। আট নম্বরে আছে রাজধানীর কুর্মিটোলার বিএএফ শাহীন কলেজ। এখানে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ২৫ হাজার ৫৪৪, আসন আছে ৮০০। দশ নম্বরে অবস্থান রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের। এখানে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ২৫ হাজার ৪২, যেখানে আসন আছে এক হাজার ৬৫০। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে মানসম্মত কলেজের সংখ্যা মাত্র ২০০টির মতো। যদি উচ্চ মাধ্যমিক পাঠদান করে এমন সব সরকারী কলেজ বিবেচনায় নেয়াও হয়, তাহলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩০০ বার তার থেকে কিছু বেশি। এসব কলেজে আসন সংখ্যা সর্বোচ্চ দুই লাখ। তাই এই মানের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে ভয়াবহ জটিলতাই অপেক্ষা করছে। অবশ্য নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তির নিয়ম করায় এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মেধাবীরা অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে রাজধানীতে দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণী আছে। এসব কলেজে মোট আসন আছে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এর মধ্যে ভাল মানের ২০-২২ কলেজে আসন ২৫ হাজার। বিপরীত দিকে ঢাকা বোর্ডেই এবার পাস করেছে প্রায় চার লাখ। জিপিএ-৫ পেয়েছে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, সকল শিক্ষার্থীরই কাক্সিক্ষত কলেজে ভর্তির সুযোগ নেই। এটাই বাস্তবতা। সেখানে বাইরে থেকে ভিড় জমালে কঠিন পরিস্থিতি হবে। এদিকে এবার ছয়টি কলেজে ভর্তির জন্য কোন শিক্ষার্থী আবেদনই করেননি। কলেজগুলো হলো- মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নবাবগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসা, মুন্সির তাল্লুক গার্লস আলিম মাদ্রাসা ও মাহমুদপুর রসুলপুর হামিদিয়া আলিম মাদ্রাসা, কুমিল্লা বোর্ডের কাছিয়ারা স্কুল এ্যান্ড কলেজ, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের খন্দকার আবু সাঈদ আদর্শ সায়েন্স কলেজ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আদিবাবাদ ইসলামিয়া হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ। এছাড়াও সারাদেশের ১৫৪ কলেজ ও আলিম মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য ন্যূনতম একজন থেকে সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আবেদন করেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এটা পরিষ্কার এসব প্রতিষ্ঠানকে কোনভাবেই গ্রহণ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠান রাখা না রাখার বিষয়টিও ভাবা জরুরী। তবে আগামী ৫ তারিখে প্রথম মেধা তালিকা প্রকাশের পর পরবর্তী তালিকায় কিছু শিক্ষার্থী এখানে আবেদন করতে পারেন বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। সেই সংখ্যাও ১০ জনের বেশি হবে না বলেই মনে করছেন তারা। ভর্তির সর্বশেষ ভর্তির সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে, যেসব শিক্ষার্থীর পুননিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছে তাদের ফল বাজ প্রকাশ হবে। ফল পরিবর্তন হলে তারা আজ ও আগামীকাল ভর্তির আবেদন করতে পারবেন। তবে শিক্ষার্থীদের মেধা ও পছন্দক্রমের ভিত্তিতে একটি মাত্র কলেজ নির্বাচন করে দেবে শিক্ষা বোর্ডগুলো। ৫ জুন প্রথম পর্যায়ে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের ফল প্রকাশ করা হবে। ৬ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত এসএমএসের মাধ্যমে ১৮৫ টাকা ফির বিনিময়ে কলেজ নিশ্চয়ন করতে হবে। এরপর মাইগ্রেশনের আবেদন এবং নতুন আবেদন করা যাবে ৯ থেকে ১০ জুন। ১৩ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের ফল দেয়া হবে। তাদের ১৪ ও ১৫ জুন কলেজ নিশ্চয়ন করতে হবে। এরপর আবার মাইগ্রেশন ও নতুন আবেদন করা যাবে ১৬ ও ১৭ জুন। তৃতীয় পর্যায়ে ফল প্রকাশ করা হবে ১৮ জুন। এদিকে আসন্য ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে ভর্তির তারিখ নির্ধারণ করায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ বাড়ছে। তারা দ্রুত তারিক ঈদের পর নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন।
×