ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিদার হাসান

‘আমিও আছি শেষ খেয়াপারের অপেক্ষায়...’

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৯ মে ২০১৭

‘আমিও আছি শেষ খেয়াপারের অপেক্ষায়...’

পেশাদার কূটনীতিক, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী আর নেই... এ সংবাদটি যখন সকালে চোখে পড়ল, মুহূর্তে মনে পড়ে গেল তারই একটি করুণ উক্তি- ‘আমিও আছি শেষ খেয়াপারে অপেক্ষায় কখন ডাক আসবে... এই তো জীবন!’ কথাটি তিনি আমায় বলেছিলেন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার বাসায় যখন তার একটি সাক্ষাতকার গ্রহণ করতে ছিলাম তখন। তাঁর কবিবন্ধু সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যু প্রসঙ্গ আসাতে বললেন মৃত্যুর বারো দিন আগে হককে দেখতে আমি হাসপাতালে গেলে আমার হাত চেপে ধরে ওঁ বলল- ‘দোস্ত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করব আমরা ২০২০ সালে মহাসমারোহে। আমি লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকদের দিকটা দেখব, তুই দেখবি দেশ-বিদেশের সরকারী আমলা-মন্ত্রী-রাজনীতিকদের।’ কী প্রাণশক্তি, কী মনোবল তার। অথচ মাত্র ১২ দিনের মাথায় ওঁ চলে গেল! আমিও আছি শেষ খেয়াপারের অপেক্ষায়... ফারুক চৌধুরী তখন বন্ধু বিয়োগের ব্যথায় বড় বেশি কাতর ছিলেন, নিজেও যে কোনো সময় যেতে পারেন এমন শঙ্কা, ভাবনায় জড়িয়ে ছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত ওই পথেই হাঁটলেন ১৭ মে ২০১৭-এর প্রভাত বেলায়। আমার মনে থেকে থেকে তাঁর মুখের ওই কথাটিই বেজেছে- আমিও আছি শেষ খেয়াপাড়ের অপেক্ষায়...। বাস্তবিকই জীবনের ব্যাপ্তি বিশাল এবং বিচিত্র হলেও, আয়ু সত্যি কম। এক জীবনে ফারুক চৌধুরীর অর্জন নেহাত কম নয়; হিসাব কষে দেখলে বোঝা যাবে কত বর্ণাঢ্য তার যাপিতজীবন। ক্যারিয়ার! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়নকালেই পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন তিনি প্রবেশনার প্রশিক্ষণ শেষে তৃতীয় সচিব হিসেবে ১৯৫৬ সালে। চাকরি জীবনের প্রথম দুই বছর তার কেটেছে বিদেশে প্রশিক্ষণে-বোস্টনের ফ্লেচার স্কুল অব ল এ্যান্ড ডিপ্লোমেসি, ওয়াশিংটনের জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ফরেন সার্ভিস ইনস্টিটিউট এবং লন্ডনের ফরেন অফিসে। তারপর প্যারিসে ৬ মাস ফরাসী ভাষা অধ্যয়ন এবং প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কূটনৈতিক হিসেবে রোম, বেজিং, দি হ্যাগ, আলজিয়ার্স, ইসলামাবাদ এবং ঢাকা পররাষ্ট্র দফতরের শাখা অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে, প্রথম রাষ্ট্রাচার প্রধান হিসেবে, ১৯৭২-৭৬-এ তিনি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডেপুটি কমিশনার, ১৯৭৬ সালে আবুধাবিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে, ১৯৭৮ সালে ব্রাসেলসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আর ১৯৮২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইসলামিক পররাষ্ট্র সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে এবং ১৯৮৪ সালে পররাষ্ট্র সচিব এবং ১৯৮৬-৯২ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সুনাম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে কূটনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি যুক্ত হন ব্র্যাকের উপদেষ্টা পরিষদে, ১৬ বছর তিনি এখানে কাজ করেছেন। তাছাড়া ডেলটা ব্র্যাক হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন তিনি আওয়ামী লীগের বিদেশ সম্পর্কের কমিটির চেয়ারম্যানও; সুলেখক হিসেবেও তার পরিচয় পরিব্যাপ্ত। ১২টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে তার। প্রথম গ্রন্থ দেশ-দেশান্তের প্রকাশ হয় ১৯৯৪ সালে, তারপর একে একে প্রিয় ফারজানা, নানাজন নানা কথা, জানালায় নানা ছবি, স্মরণে বঙ্গবন্ধু, গতকাল সমকাল, রবীন্দ্রনাথ; শান্তির দূত, স্বদেশ-সকাল-স্বজন, সময়ের আবর্তে, অনাবিল মুখচ্ছবি, জীবনের বালুকা বেলায় ইত্যাদি। মূলত ১৯৯২-এ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরই তার নিয়মিত লেখালেখি। একটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখতেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তাঁর ভাষা সাবলীল, সাহিত্য মানসম্পন্ন। ‘জীবনের বালুকা বেলায়’ স্মৃতিকথামূলক এ গ্রন্থের জন্য তিনি ২০১৫ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। এর বাইরেও পেয়েছেন- ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৬), আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কার (২০১৪)। অর্থাৎ নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধতার জীবন। ‘জীবনের বালুকা বেলায়’ তাঁর আত্মজৈবনিক লেখা। বইটি পড়ে খুবই উৎফুল্ল হয়েছিলাম, তাই নিজ থেকেই লিখছিলাম এর আলোচনা। দেখে তিনি খুশি হয়েছিলেন, চা খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশে বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মেশার সুযোগ ঘটেছে তাঁর পেশার সুবাদে, দেখেছেন কত দেশের কত মানুষের জীবনযাপন, জেনেছেন তাদের সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ইতিহাস। তাঁর এ গ্রন্থেও এর বিশদ উল্লেখ আছে। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর একটা ধারণা ছিল, ছিল এ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলও; যে কারণে সময় পেলেই পছন্দের সেরা লেখকের সেরা লেখাটি পড়তে দেরি করতেন না। ’৯২ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি যখন লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন সেই থেকে প্রায় আমৃত্যু তার যে সব লেখা আমরা দেখেছি, তাতে এ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর স্মৃতিকথায় জীবন ও সময়ের কত কথা উঠে এসেছে। ভেবে বিস্মিত হই তার প্রখর স্মৃতিশক্তির পরিচয়ে। ফারুক চৌধুরী তার দেশ-দেশান্তর গ্রন্থের ৭৮-৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ’১৯৭১-এ ভারতে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রধান যোগাযোগ রক্ষাকারী ডি.পি.ধর (দুর্গাপ্রসাদ ধর) ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা। তাই বোধকরি মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী কিছু বন্ধুবান্ধব ঠাট্টাচ্ছলে তার আড়ালে বলতেন ‘ধরকে ধর’। ... ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা বিমানবন্দরে তাকে সংবর্ধনা জানাতে গিয়েই নিশ্চিত হওয়া গেল যে ডি.পি.ধর এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে। রাষ্ট্রদূত হিসেবে নন। ডি.পি.ধরই ছিলেন ঢাকার বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রীয় মেহমান।... তেইশে ডিসেম্বর ঢাকা পৌঁছে সেই সন্ধ্যায়ই ধর সাহেব গেলেন বেগম মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতকারে। ধানম-ির আঠারো নম্বর রাস্তায় বেগম মুজিবের সংগ্রামকালীন অস্থায়ী আবাসস্থলে। সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা, বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা আবদুস সামাদ আজাদ। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্বন্ধে বাংলাদেশ-ভারত সম্ভাব্য যুক্ত পদক্ষেপ সম্বন্ধে তারা উপরোক্ত বিবৃতি সত্ত্বেও, সেই সাক্ষাতকারে ছিলেন অনুপস্থিত। দোভাষীর মাধ্যমে বেগম মুজিব তার অন্তরীণকালীন অবস্থার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূতকে। আবেগময় সেই পরিস্থিতির মাঝেও বেগম মুজিবের সংযত ব্যবহার সন্বন্ধে ডি.পি.ধর সেদিন মন্তব্য করেছিলেন আমাদের কাছে। উল্লেখ করেছিলেন, বেগম মুজিবের বাসগৃহের আসবাবপত্র ইত্যাদির অতি সাধারণ মানের কথা। ইন্দিরা গান্ধীর তরফ থেকে ডি.পি.ধর বেগম মুজিবকে জানালেন ভারত, বিশেষ করে আজমির শরিফ সফরের আমন্ত্রণ। নিশ্চয়ই যাব, বললেন বেগম মুজিব। কিন্তু এখন নয়। বললেন, বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তার সঙ্গেই যাবেন তিনি। ঢাকায় সকল মানুষের মনেই তখন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা। তার ত্বরিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আশা। অনুশ্চ, কিন্তু দৃঢ়, শান্ত কণ্ঠে বেগম মুজিব ব্যক্ত করলেন সেই আশাবাদ।’ বেগম মুজিবের মনোবল এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার সুস্পষ্ট প্রমাণ এর মধ্যে নিহিত, অন্যদিকে বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোশতাক সম্পর্কে ডি.পি.ধরের ধারণা তখনই যে স্পষ্ট হয়েছিল তারও ধারণা পাওয়া যায় ফারুক চৌধুরীর এ লেখা থেকে। ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় (২০০৫) দৈনিক সমকালে যোগ দেয়ার অব্যাবহত পরে। আমৃত্যু তার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় ছিল। গত ছয় ও নয় ডিসেম্বর (২০১৬)। পর পর দু’দিন তার বাসায় যাই এবং তার সাক্ষাতকার নেই। সম্ভবত এটাই সংবাদপত্রে তার শেষ সাক্ষাতকার। এরপর জানুয়ারিতে আর একবার যাই সাক্ষাতকারের কিছু নতুন বিষয় যোগ করতে। তিনি ধৈর্য ধরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং নির্ভুল করার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। সেদিন সকালে তার ছোট ভাই ইনাম আহমেদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। দু’জনকে একত্রে দেখে সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম ছবি তুলে। অসুস্থ ভাইকে দেখতে বোধকরি ছোট ভাই মহম্মদপুর থেকে নিয়মিতই আসেন। শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। দু’ভাই ভাব বিনিময় তথা স্মৃতিচারণাও করেন; জীবনের উপান্তে এসে আত্মীয়-পরিবারের চেয়ে শৈশব-কৈশরের কথাই যে বেশি মনে পড়ে তা বুঝলাম ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে সেদিন ক্ষাণিক আলাপেই। আমার হাতের ক্যামেরাটি দেখে বললেনÑ ‘আমার বারো বছর বয়সের সবচেয়ে প্রিয় এবং শখের সম্পত্তি ছিল ১৬ টাকা দামের একটি ব্রাউনি ক্যামেরা, যার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সে আমার ভাল লাগা অতীত। স্মৃতির পর্দায় নিয়ত অপসৃয়মান অতীত।’ সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই বেশি স্মৃতিচারণ করলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণ তিনি কিভাবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ইংরেজীতে পাঠ করিয়েছিলেন, তার আগে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন মনে করবা তুমিই প্রেসিডেন্ট, এমনভাবে পড়বা। ফারুক চৌধুরীর সাবলীল ভাব-ভঙ্গিমায় মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে বাহবা দিয়েছিলেন এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি সেদিন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, লক্ষ্য করেছি তখন তাঁর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। সেদিন তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা বহাল থাকবে এবং একটি সার্থক, উন্নয়নগামী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অচিরেই আত্মপ্রকাশ করবে, তবে এ জন্য রাজনৈতিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা জরুরী। আর সবচেয়ে বড় কথা তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে, তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে। ফারুক চৌধুরী দারুণ আশাবাদী মানুষ ছিলেন। তার মনে কোন খেদ, না পাওয়ার বেদনা ছিল কিনা জানি না। অনেক বারই তার মুখে শুনেছি জীবনে যা চেয়েছি তাঁর চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেদিন বলেছেনÑ আকাশেতে আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস/ তবু উড়েছিনু এই মোর উল্লাস। আসলে বড় মানুষের বিনয়টা বেশি থাকে। জীবনে কত কি দেখেছেন, জেনেছেন কম মানুষেরই জীবনে সে সুযোগ-সৌভাগ্য হয়। শিক্ষা সামাজিক অবস্থান বিচার করলে তাদের যে পারিবারিক ঐতিহ্য তা অনন্য দৃষ্টান্ত। পিতা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য চার সন্তানও সচিব, রাষ্ট্রদূত ছিলেন। জীবন ছোট হলেও কীর্তির মহিমা নেহাত ছোট নয়! লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×