ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেউ বলছেন জাম্বোসাইজের কমিটি, বিতর্কিতদের ঢোকানো হয়েছে

ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে নেতায় নেতায় ক্ষোভ, চলছে স্নায়ুযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৯ মে ২০১৭

ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে নেতায় নেতায় ক্ষোভ, চলছে স্নায়ুযুদ্ধ

সোহেল তানভীর ॥ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য হবে ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট। গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে লাগামহীনভাবে ছাত্রলীগে পদ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের একটি সূত্র জনকণ্ঠকে জানিয়েছে, গঠনতন্ত্র না মেনে লাগামহীন পদ দেয়ায় বর্তমান ছাত্রলীগের নির্বাহী সংসদে বিতর্কিত ছাত্র সংগঠনের অনেকেই পদ পেয়েছে। এদিকে, বর্তমান ছাত্রলীগের কমিটির আকার কত জানতে চাওয়া হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা বলেছেন। কেউ বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সদস্য সংখ্যা ৩০১ আছে। অনেকে বলেছেন, কমিটির মতে আকার জাম্বো সাইজের হয়ে গেছে। তাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মধুর ক্যান্টিনে এ নিয়ে রীতিমতো চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। অবশ্য এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেছেন, কমিটির আকার ৩০১ই আছে। শূন্য পদগুলো পূরণ করা হয়েছে। ৩০১ সদস্যের কমিটির বাইরে যারা আছে সবাই সিসি মেম্বার। ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক দেলোয়ার শাহজাদা জানান, বর্ধিত কমিটি দেয়ার আগে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য ছিল ২৭২। হল কমিটিতে পদ পায়নি এমন ৬১ জনকে এবার পদ দেয়া হয়েছে। তাই বর্তমানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩৩। এদিকে, রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেও অনেকে পদ বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশে দেখা না গেলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছের বিবেচনায় অনেককে পদ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগে পদ পেতে হলে তাকে অবশ্যই ছাত্র হতে হবে। কিন্তু বর্তমান কমিটিতে ৭ সাংবাদিক রয়েছেন যাদের ছাত্রত্ব নেই। এছাড়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে ছাত্রদল-শিবির করার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, সাংবাদিকরা ছাত্রলীগ করতেই পারে। আর যাদের শিবির আখ্যা দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রমূলক। যাদের শিবির বলা হচ্ছে তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী সবাই আওয়ামী লীগ। প্রতিবছর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এবার কমিটি ঘোষণা করার আগে কোন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি করে গণমাধ্যমে কমিটি প্রকাশও করা হয়নি। যারা পদ পেয়েছেন তাদের চিঠির মাধ্যমে পদ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সোহাগ বলেন, পদ দেয়া শেষ হলে আমরা একসঙ্গে গণমাধ্যমে জানাব। যে কোন সময়ই কমিটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। গঠনতন্ত্রে বলা আছে, কমিটি যদি বর্ধিত করতে হয় তাহলে সভা করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক-তৃতীয়াংশের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি বর্ধিত করা যাবে। কিন্তু বর্তমান কমিটি বর্ধিত করার আগে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের মতামত না নিয়েই পদ দিয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, কমিটি বর্ধিত করা হয়নি। কেবল শূন্য পদগুলো পূরণ করা হয়েছে। অনেকে বিয়ে করেছেন, অনেকের ছাত্রত্ব চলে গেছে তাদের পদ পূরণ করা জন্য পদ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া কমিটি দেয়ার বিষয়টি জানেন না কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কোন নেতা। ফলে কমিটিতে ছাত্রদল ও শিবিরের অনেক নেতার জায়গা হয়েছে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। এ নিয়ে ছাত্রলীগে বিভ্রান্তি দেখা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক নেতা বলেন, ছাত্রলীগের ইতিহাসে বর্তমান কমিটি সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক ও গঠনতন্ত্রবিরোধী। বর্তমান দুই নেতা চরম স্বেচ্ছাচারী ও আঞ্চলিকতায় বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের অনেক নেতার দাবি, বর্তমান কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য নেতাদের কোন মতামত কিংবা পরামর্শ তোয়াক্কা করা হয় না। কেন্দ্রীয় সংসদের বর্ধিত কমিটি গঠনের আগে নির্বাহী সংসদের সদস্যদের কোন পরামর্শ নেয়া হয় না। থানা ও জেলা কমিটি গঠনে নির্বাহী সংসদের মতামত নেয়া হয় না। তাদের অভিযোগ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি দুই মাস পর পর সভা হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন সাধারণ সভা হয়নি। ২০১৫ সালে সম্মেলনের সময় পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠনের প্রায় একবছর পর পূর্ণাঙ্গের সময় অনেকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদে পদ বঞ্চিত হয়। এই পূর্ণাঙ্গ কমিটি একবছর পার হলেও পদ বঞ্চিতদের একটি অংশকে কোন পরিচয় দেয়া হয়নি। যার দরুন সম্প্রতি মধুর ক্যান্টিনে পদ চেয়ে বিক্ষোভ করে অনেকে। এবারও তাদের কোন পদ দেয়নি। এছাড়াও অনেক হলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশীরাও কোন পদ পায়নি। এই বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ সূত্র জানায়, পদ বঞ্চিত এই গ্রুপটি বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এছাড়াও অনেকে আগামী ২৪ জুলাইয়ের পর নতুন সম্মেলনেরও দাবিও তুলেছে। এ জন্যই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে বড় কমিটি দেয়া হয়েছে। যারা রাজনীতিতে সক্রিয় তারাও পদ পেয়েছেন আবার যারা একদিন রাজনীতিতে ছিল না তারাও পদ পেয়েছেন। প্রথম সারির দুটি পত্রিকায় তিন সাংবাদিককেও পদ দেয়া হয়েছে। যা নিয়ে সংগঠনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক নেতা বলেন, রাজনীতি করে কি হবে? সাংবাদিক হতে চাই। যারা একদিনও ‘জয় বাংলা’Ñ স্লোগান দেয়নি কিন্তু পদ পেয়েছে। শীর্ষ নেতাদের তোষামোদ করে সংবাদ প্রকাশ করায় পদ দেয়া হয়েছে। এভাবে একটি সংগঠন চলতে পারে না। যেখানে শত শত কর্মী রাতদিন পরিশ্রম করেও পদ পাচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি ব্যর্থ একটি কমিটি। জাতির জনকের গণতান্ত্রিক এই সংগঠনে বর্তমানে নেই কোন গণতন্ত্রের চর্চা। এই কমিটিতে ছাত্রলীগ মানেই সোহাগ জাকির। অন্য যারা কমিটিতে আছে তাদের মতামতের কোন তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, ছাত্রলীগের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় কমিটিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের অনেক নেতাকর্মী স্থান পেয়েছেন। এভাবে যারা ডেডিকেটেড ও সিনিয়র তাদের বঞ্চিত করে কমিটি দেয়ায় এখানে চেন অব কমান্ড থাকবে না। এখানে অনেক সিনিয়র বঞ্চিত হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রথম হলে পদ পাবে, তারপর বিশ^বিদ্যালয়ে এবং সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটিতে। কিন্তু হলে রাজনীতি না করেও বর্তমান কমিটিত অনেকে পদ পেয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২০১৫ সালের ২৫-২৬ জুলাই সম্মেলনে বর্তমান কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে সোহাগ-জাকির প্যানেল নির্বাচিত হয়। এর সাত মাস পর ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। গত ২০ মে কমিটি বর্ধিত করা হয়।
×