ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জটিল এই আইনের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়বে ;###;১ শতাংশ ভ্যাট কমলে রাজস্ব কমবে ৮ হাজার কোটি টাকা ;###;নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন পণ্যে ভ্যাট আরোপ হবে না- এনবিআর চেয়ারম্যান

দীর্ঘ পাঁচ বছরের টানাপোড়েন শেষ ॥ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৯ মে ২০১৭

দীর্ঘ পাঁচ বছরের টানাপোড়েন শেষ ॥ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন

রহিম শেখ ॥ আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন। আইনটির ভাল-মন্দ ভোক্তাশ্রেণী না বুঝলেও এটা স্পষ্ট যে, অনেক খাতেই নির্ধারিত হারে ভ্যাট দিতে হবে। ধারণা করা হয়েছিল ব্যবসায়ী ও ভোক্তার চাপে এই হার কিছুটা কমে আসবে। গত শনিবার অর্থমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘১৫ শতাংশ থেকে কমানো হচ্ছে না।’ আইনটি কার্যকর হলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি হারে ভ্যাট দিতে হবে। এই তালিকায় আছে দেশী ব্র্যান্ডের পোশাক, ভোজ্যতেল, চিনি, সুপারশপ, নির্মাণসামগ্রীর রড, বিদ্যুত বিল, ওষুধ, সোনার গয়না ইত্যাদি। এতে এসব পণ্যের দাম যেমন বাড়বে তেমনি ভোক্তার জীবনযাত্রার ওপর চাপ পড়বে। পণ্যের দাম বাড়লে ভোক্তা পণ্য কম কেনেন। তখন ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েন। এ কারণে ভ্যাট আইনের কারণে উদ্বিগ্ন ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। ভোক্তা পর্যায়ে জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। এনবিআর দাবি করছে, ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে হিসাব রাখতে পারলে দাম তো বাড়বেই না বরং কমবে। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, জটিল এই আইনের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়বে। রেয়াত নেয়াও কঠিন হবে। অর্থনীতিবিদরাও এক লাফে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেয়ার পক্ষে নন। জানা গেছে, দীর্ঘ পাঁচ বছর টানাপোড়েনের পর আগামী ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে এনবিআরকে চূড়ান্ত নির্দেশনাও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এনবিআর বলছে, ভ্যাটের হার ১ শতাংশ কমলে ৮ হাজার কোটি টাকা এবং ৩ শতাংশ কমালে ২৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কমে যাবে। অর্থমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, আইন সংশোধন করে ভ্যাটের হার ১ শতাংশ কমানো হলেও বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হবে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নতুন আইনে ভ্যাটের হার প্রায় সব খাতে ১৫ শতাংশ আরোপের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে প্রায় সব খাতেই পণ্যের দাম বাড়বে। বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে। তবে এই হার মূল্য সংযোজনের ওপর নেয়া হয়। অর্থাৎ যেখানে যে পরিমাণে মূল্য সংযোজন হয় সেখানে সে হারে ভ্যাট নেয়া হয়। এর ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বনিম্ন দেড় শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট রয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু খাতে আড়াই, সাড়ে ৪, ৫, বা ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত রয়েছে। এগুলো ১৫ শতাংশ হয়ে গেলে পণ্যের দাম বেড়ে ভোক্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সূত্রে জানা যায়, বিদ্যমান আইনে স্থানীয় অনেক পণ্যে বিশেষ ছাড় দিয়ে নির্ধারিত ট্যারিফের ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করা হয়। এ ব্যবস্থায় কর আদায় করায় পণ্যের উৎপাদন খরচ কম হয়। এমন পণ্যের মধ্যে গুঁড়ো দুধ, বিভিন্ন মসলা, বিস্কুট, এলপি গ্যাস, কাগজ, ইট, বৈদ্যুতিক খুঁটি, রড, বিদ্যুতসাশ্রয়ী বাল্বসহ আরও কিছু পণ্য রয়েছে। নতুন আইনে এগুলোর উপকরণে কর রেয়াত নেয়া সম্ভব নয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। নতুন আইনে নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্য উঠে যাওয়ায় এসব পণ্যের দাম বাড়বে। যেমন, বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে প্রতিটন রডে ভ্যাট আদায় করা হয় ৯০০ টাকা। নতুন আইন কার্যকর হলে প্রতিটনে ভ্যাট দিতে হবে সাত হাজার টাকার বেশি। এতে রডের দাম বেড়ে যাবে। রড উৎপাদনের ক৭াচামাল স্ক্র্যাপ, ভাঙ্গাড়ি, লোহার সামগ্রী ইত্যাদি ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ফলে এসব উপকরণের কর রেয়াত নেয়া সম্ভব নয়। কর রেয়াত সুবিধা না নিতে পারলে দাম বাড়িয়ে দেবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া রডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নাট-বোল্ট, তারক৭াটা, স্ক্রু ইত্যাদির দামও বাড়বে। শুধু রডের ক্ষেত্রে নয়, উপকরণের রেয়াত নেয়ার সুযোগ না থাকায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে। নতুন আইন কার্যকর হলে বিভিন্ন ওষুধের দামে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ওষুধের বিপণন প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হবে। কারণ, বড় ওষুধ বিক্রেতাকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। অন্যদিকে, ছোট ব্যবসায়ীদের ৩ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এতে ওষুধের দাম নির্ধারণ নিয়ে বিশাল ফারাক তৈরি হবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও এখন উৎসব-পার্বণে দেশী ব্র্যান্ডের বাহারি ডিজাইনের শার্ট, পায়জামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি কেনেন। দেশী ব্র্যান্ডের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শোরুমে ক্রেতারা যত টাকার পণ্য কেনেন, তাতে ৪ শতাংশ মূসক দিতে হয়। কিন্তু ১ জুলাই থেকে মূসক এক লাফে ১৫ শতাংশ হয়ে যাবে। এক হাজার টাকার কাপড়চোপড় কিনলে বর্তমানে ৪০ টাকা মূসক দিতে হয়। নতুন হিসাবে সেটা বেড়ে ১৫০ টাকা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশী ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির সভাপতি ও সাদাকালোর কর্ণধার আজহারুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ১৫ শতাংশ মূসক আরোপিত হলে দেশী পোশাক কেনার আগ্রহ হারাবে ক্রেতা। কেননা, এতে পোশাকের দাম বাড়বে। তার মতে, কাপড় কেনার সময় তাঁতি মূসক চালান দিতে পারবেন না। আবার ওই তাঁতি উপকরণ রেয়াতও নিতে পারবেন না। কারণ ওই তাঁতি যখন সুতা, রং কেনেন তখন তো রসিদ পান না। এভাবে প্রতিটিস্তরেই বেশি মূসক দিতে হবে; যা প্রস্তুত কাপড়চোপড়ের দাম বাড়িয়ে দেবে। এটা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তরা বড় বড় শহরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুপারশপে বাজার করেন। বর্তমানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এসব সুপারশপে বাজার করলে মোট কেনাকাটার ওপর ৪ শতাংশ হারে মূসক দিতে হয়। নতুন আইনে সেখানে ১৫ শতাংশ হারে মূসক দিতে হবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয়, পাড়া-মহল্লায় এমন শত শত রেস্তরাঁ আছে। এসব রেস্তরাঁয় খাবারের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ মূসক বিদ্যমান রয়েছে। ১ জুলাইয়ের পর খাবারের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক দিতে হবে। যদিও বহু রেস্তরাঁয় গ্রাহককে এই মূসকের চালান দেয়া হয় না। জানা গেছে, বর্তমানে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল আমদানিতে কোন মূসক দিতে হয় না। ১ জুলাই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ১৫ শতাংশ মূসক দিতে হবে। এতে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ ও বন্দর থেকে বেরোনোর আগেই ১৫ শতাংশ মূল্য বেড়ে যাবে। ভোক্তার কাছে আসা পর্যন্ত স্তরে স্তরে দাম বাড়বে। শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকে বেশি দামেই ভোজ্যতেল কিনতে হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও মূসকের কারণে স্থানীয় বাজারেও আনুপাতিক হারে দাম বাড়বে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের শীর্ষস্থানীয় তেল ও চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, নতুন আইনে প্রতিস্তরে ভ্যাট বসলে চিনি ও তেলের দাম বেড়ে যাবে। এই উদ্বেগের কথা তারা (ব্যবসায়ীরা) সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ জাকির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, রড ও সয়াবিন তেল ছাড়া কোন পণ্যের দামই বাড়বে না। তিনি আরও জানান, নতুন আইনে পণ্যের খুচরা দাম ঠিক করতে হবে মূসকের টাকা অন্তর্ভুক্ত করেই। আলাদা করে মূসক নেয়া যাবে না। ভোক্তার পকেট থেকে এক টাকাও বাড়তি যাবে না। বিষয়টি নির্ভর করবে ব্যবসায়ীর ব্যবসায় নৈতিকতা এবং সঠিকভাবে হিসাব রেখে রেয়াত নেয়ার ওপর। এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, গত এবং চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে অনেক পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা আছে। একই সঙ্গে অন্য হারেও ভ্যাট আদায় হচ্ছে। ভবিষ্যতে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে অভিন্ন ভ্যাট চাই না। আমরা কিছু পণ্য ও কিছু খাতে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট নির্ধারণ এবং কিছু পণ্য ও কিছু খাতে ভ্যাট অব্যাহতি চাই। আমরা রেয়াতের বিষয়ে নিশ্চয়তা চাই। বর্তমানে দেশীয় চা শিল্পের সুরক্ষায় আমদানি করা চায়ে ২০ ভাগ সম্পূরক শুল্ক আরোপ আছে। নতুন আইনে এ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার হলে বিদেশ থেকে আনা চা সস্তা হবে। এতে দেশীয় চা শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চায়ের মতো নতুন আইনে আমদানি পর্যায়ে বেশিরভাগ পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক তুলে নেয়া হবে ও অনেক পণ্যে তা কমানো হবে। ফলে বিদেশ থেকে আনা এসব পণ্য আগের চেয়ে সস্তা হবে। এর বিপরীতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের খরচ বেড়ে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে দেশীয় শিল্প। এদিকে বর্তমানে গ্রাহকদের বিদ্যুত বিলের ওপর এখন ৫ শতাংশ হারে মূসক দিতে হয়। কোন গ্রাহকের বিদ্যুত বিল এখন যদি এক হাজার টাকা হয়, তাহলে ৫০ টাকা মূসক দিতে হয়। নতুন আইন হলে ওই ব্যক্তিকে ১৫০ টাকা মূসক দিতে হবে। খরচ বাড়বে ১০০ টাকা। যদিও বিদ্যুতের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়। তাই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে সরকারকে ইউনিটপ্রতি দাম কমাতে হবে। সরকারী-বেসরকারী বিদ্যুত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকেও রেয়াত নিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদনমূল্য কমাতে হবে। জানা গেছে, বর্তমানে ১৫ ধরনের সেবায় সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে মূসক আরোপ করা হয়। এই হার দেড় থেকে ১০ শতাংশ। নতুন আইনে ওই সেবাতেই ১৫ শতাংশ হারে মূসক বসবে। এতে খরচ বাড়বে ফ্ল্যাট কেনা, আসবাবপত্র কেনা, গাড়ি মেরামত, গাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন সেবায়। এ ছাড়া বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যে ট্যারিফ মূল্যের ওপর ভিত্তি করে মূসক আরোপ করা হয়। এই ব্যবস্থা উঠে গিয়ে উৎপাদন পর্যায় থেকে সরবরাহ পর্যায়ে যাওয়ার জন্য যে লেনদেন মূল্য থাকবে, এর ওপরই মূসক বসবে। যেমন চিনি আমদানি। এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে জনসাধারণের সুবিধায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কোন ভ্যাট আরোপ করা হবে না। একই সঙ্গে ছোট ব্যবসায়ীরা ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি পাবেন। ফলে নতুন ভ্যাট আইনে উদ্বেগের কিছু নেই। ব্যবসায়ীরা নতুন এ আইন নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান ও সহায়তা করবেন বলে আশা করি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নতুন মূসক আইন বাস্তবায়িত হলে পণ্যের দাম শুরুতেই বেড়ে যাবে, যা ভোক্তাকে বেশ ভোগাবে। মূসকের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে। অবশ্য পরে বাড়তি মূল্যেই পণ্যের দাম ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, রেয়াতি হারে মূসক রাখার পক্ষে আমি নই। মূসক সবক্ষেত্রেই এক হার হতে হবে। তবে ১৫ শতাংশ মূসক একটু বেশিই। এটা ১০ শতাংশ করা উচিত।
×