ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতার অভিযোগ ভিত্তিহীন, আমলে নেয়নি দিল্লী

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২৮ মে ২০১৭

মমতার অভিযোগ ভিত্তিহীন, আমলে নেয়নি দিল্লী

তৌহিদুর রহমান ॥ দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছেন, তার পুরোটাই ভিত্তিহীন। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী নিয়ে মমতার উত্থাপিত অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। মমতার এসব অভিযোগ আমলেও নেয়নি দিল্লী । মূলত তিস্তা চুক্তি এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ভিত্তিহীন বিভিন্ন ইস্যু সামনে আনছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক বৈঠকে মমতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ তোলেন। এসবের মধ্যে রয়েছে চুর্নি নদীর দূষণ, আত্রাই নদীর ওপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাঁধ দেয়া ও আমের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি। তবে মমতার এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। মোদির কাছে নালিশ জানিয়ে মমতা বলেছেন, ভারতের চুর্নি নদীর পানি দূষিত করছে বাংলাদেশ। এতে নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুষ্টিয়া জেলায় পদ্মা নদী থেকে মাথাভাঙ্গা নদীটি উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার মাজদিয়াতে এসে দুটি প্রবাহে ভাগ হয়েছে। এর একটি হলো চুর্নি নদী। যেটি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মাজদিয়া, শিবনিবাস, হাঁসখালী, বীরনগর, আরংঘাটা, রানাঘাট, চাকদহ দিয়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে হুগলী নদীতে গিয়ে মিশেছে। সূত্র জানায়, চলতি মাসের গোড়ারদিকেই নদিয়া জেলায় এক প্রশাসনিক বৈঠকেই কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস বিষয়টি নিয়ে মমতার কাছে অভিযোগ জানান। তৃণমূলের বিধায়ক নদী দূষণের জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। সেই সময়ে কোন তদন্ত ছাড়াই শুধু অভিযোগ পেয়ে মমতা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমনকি এর স্বপক্ষে কোন দলিলাদি মোদিকে দেখাতে পারেননি মমতাও। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগও তুলেছেন মমতা। এছাড়াও মমতা দিল্লীতে মোদির কাছে অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশ আত্রাই নদীর পানি আটকে রাখছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের চাষীরা। আবার এক সঙ্গে অনেকটা জল ছাড়ায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারকে আলোচনা করতেও অনুরোধ করেছেন তিনি। সূত্র জানায়, দিনাজপুর জেলা দিয়ে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জ ব্লকের সাফানগর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে আত্রাই নদী। এরপর ওই নদী দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লক দিয়ে ৫২ কিলোমিটার পথ শেষ করে ডাঙ্গিজলঘর হয়ে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় ঢুকেছে আত্রাই। তবে আত্রাই নদীর রাবার ড্যাম নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। আর এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৪ সালের শেষদিকে। প্রায় তিন বছর আগে আত্রাই নদীর ওপর রাবার ড্যাম নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এ নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কখনই কোন অভিযোগ ওঠেনি। তবে এখন নতুন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের এই অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কারণে মালদহ জেলার আম বাংলাদেশে রফতানি করতে পারছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন মমতা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে আম আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে মমতা কখনই কোন অভিযোগ তোলেননি। তবে এতদিন পরে মমতার এই অভিযোগও তিস্তা নিয়ে পাল্টা কৌশলের একটি অংশ বলে মনে করছেন বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭-১০ এপ্রিল ভারত সফর করেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে মমতা তোর্সা, মানসাই, ধানসাই ও ধরলা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে এসব নদীর কোনটিই তিস্তার বিকল্প হতে পারে না বলে ঢাকার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই দিল্লীকে জানানো হয়েছে। কেননা তিস্তা নদী লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ অংশেই পড়েছে ১১৫ কিলোমিটার। তিস্তার চাপ এড়াতেই বৃহস্পতিবার মোদির সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মমতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন নতুন ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন বলেই জানা গেছে। তবে দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মমতার এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ আমলে নেয়নি দিল্লী। এছাড়া তোর্সা, মানসাই, ধানসাই, ধরলা নদীর কোনটিতেই ব্যারাজ নেই। সে কারণে এসব নদীর পানি বাংলাদেশ এমনিতেই পাচ্ছে। তবে তিস্তার ভারত অংশে গজলডোবা বাঁধ থাকায় তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুবিধামতো ব্যবহার করছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। তিস্তার ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি। সে কারণে তিস্তা এসব নদীর কোন বিকল্প হতে পারে না বলে ঢাকার পক্ষ থেকে দিল্লীকে ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে। তোর্সাসহ চার নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যৌথ সমীক্ষা করার নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন মমতা। তবে এসব নদীর পানি নিয়ে যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব মানে সময়ক্ষেপণ করা ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করছেন ঢাকার শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা। এছাড়া এসব নদীর পানি নিয়ে সমীক্ষার কিছু নেই। কেননা এসব নদীতে ব্যারাজ না থাকায় বাংলাদেশ এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে এসব নদীর পানি পাচ্ছে। তিস্তা চুক্তিতে মোদি সরকারের কোন আপত্তি নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা চুক্তি করতে আগ্রহী। তিনি শুরু থেকেই এটা বলে আসছেন। তিনি মমতাকে পাশে নিয়েই এই চুক্তি করতে চান। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের বিকল্প প্রস্তাবে বিব্রত হয়েছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। আর কেন্দ্রীয় সরকার মমতার বিকল্প প্রস্তাব মানতেও নারাজ। উল্লেখ্য, ১৯৮’র দশক থেকে দুই দেশ তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গসহ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ২০১১ সালে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সে কারণে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ারও কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আটকে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় ভারত সরকার এই চুক্তি সইয়ের বিষয়ে আশ্বাস দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
×