ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওদের বাবা-মা দিনরাত ডুবে থাকেন মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনের ভাগাড়ে

বর্জ্য শ্রমিকদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখছে মৃধাবাড়ি ডে-কেয়ারে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৮ মে ২০১৭

বর্জ্য শ্রমিকদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখছে মৃধাবাড়ি ডে-কেয়ারে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মাতুয়াইল মৃধাবাড়ি এলাকা সংলগ্ন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং স্টেশন। এ এলাকায় দিন-রাত ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গার ময়লা সংগ্রহ করা ট্রাকগুলো বর্জ্য ফেলতে হরহামেশা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। এ কারণে এলাকাটি নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। মৃধাবাড়ি এলাকাজুড়ে বসবাস প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি বর্জ্যশ্রমিকের। যারা দিন-রাত ময়লার মধ্যে ডুবে থেকেই উপার্জন করে। কখনও ভাঙারি কুড়িয়ে, ভাঙারির ভ্যান টেনে, ভাঙারির ব্যবসা করে জীবিকানির্বাহ করেন নারী ও পুরুষ বর্জ্যশ্রমিকরা। বাবা-মায়ের দেখাদেখি তাদের সন্তানরাও দিন দিন এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠা এসব শিশুর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি। মাতুয়াইল মৃধাবাড়ি এলাকায় বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল বর্জ্যশ্রমিকের সন্তানরা লেখাপড়া শিখছে, ছোট বাচ্চারা ডে-কেয়ারে থাকছে। মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনের পাশেই একটি তিনতলা বিল্ডিং। দোতলায় গিয়ে চোখে পড়ল একটি বেশ বড়সড় ঘর। মেঝে জুড়ে পাটি বিছানো। এর উপর দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের বর্ণমালা শেখাচ্ছেন দুজন শিক্ষক। পাশেই ছোট্ট রিফাত ও মনিকা ঘুমাচ্ছে। খেলনা ঘোড়ায় খেলছে আর গান গাইছে তামিম। দেড় বছরের মনিকাকে খাওয়াচ্ছেন আয়া। একটি ডে-কেয়ার সেন্টারের চিত্র। এটি মূলত বর্জ্যশ্রমিকদের সন্তানদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি পরিচালিত এই ডে-কেয়ার সেন্টারে ১০৭ জন মায়ের ১২৭ শিশু সন্তান আছে। অধিকাংশেরই বয়স ২ থেকে ৭ বছরের মধ্যে। জীবিকার তাগিদে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো কাজ করেন যারা তাদের শিশুদের নিয়েই চলছে এই ডে-কেয়ার সেন্টার। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই ডে-কেয়ার সেন্টারটিতে থাকে বাচ্চারা। ছুটি হওয়ার আগে দুপুরের খাবার দেয়া হয় শিশুদেরকে। ঠিক ১ টায় বর্জ্যশ্রমিকরা তাদের সন্তানদেরকে এসে নিয়ে যায়। সেন্টার সংশ্লিষ্টদের একজন সাইফুল জনকণ্ঠকে জানান, ‘সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই ডে-কেয়ার সেন্টারের কার্যক্রম চলে। এখানে শিশুদের সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার দেয়া হয়। একই সঙ্গে শিশুদের প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞানও দেয়া হয়। তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে বোঝানো হয়।’ তখন দুপুর ১টা। আরিফা তার মেয়েকে নিতে এসেছেন ডে-কেয়ার সেন্টারে। জনকণ্ঠকে তিনি জানালেন, ‘মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনে কাজ করেন তিনি। তার স্বামী ভাঙারির ভ্যান টানেন। স্ত্রী বিভিন্ন রকমের ভাঙ্গা জিনিসপত্র ময়লা থেকে বাছাই করেন আর স্বামী ভ্যানে করে ভাঙারি দোকানে নিয়ে যান। সকাল থেকে দেড়টা-দুইটা পর্যন্ত কাজ করেন আরিফা। তাদের চার বছরের মেয়ে তামান্না এ সময় থাকে মাতুয়াইল ডে- কেয়ার সেন্টারে। তার মতে, ‘এখানে বাচ্চা থাকলে আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি। আর ময়লার মধ্যে বাচ্চাকে নেয়া লাগে না।’ আরিফার মতো এই ডাম্পিং স্টেশনে কাজ করেন এমন অনেক নারীদের ভরসা গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির ডে-কেয়ার সেন্টারটি। গ্রাম-বাংলা উন্নয়ন কমিটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এই ডে- কেয়ার সেন্টার হওয়ার আগে প্রত্যেক মা-ই তাদের কোলের শিশুকে নিয়ে আবর্জনা ও দুর্গন্ধের মধ্যে কাজ করতেন। এখন এসব শিশুরা ডে-কেয়ারে বিনামূল্যে থাকছে, পড়ালেখা শিখছে। বর্জ্যশ্রমিকরাও এখন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটিকে ভরসা করে। ২০০৮ সাল থেকে আমরা বর্জ্যশ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করি। ২০১২ সালে ডে-কেয়ার সেন্টারটি চালু হয় এবং ২০১৫ সালে ডে -কেয়ার সেন্টার ও প্রাথমিক স্কুলটি পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ‘চাইল্ড হোপ ইউকে’ এবং বর্তমানে ‘কমিক রিলিফ আইএসএ’র ফান্ডে কাজ করছে গ্রাম-বাংলা উন্নয়ন কমিটি। শিশুদের ময়লা-আবর্জনা থেকে সরিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
×