ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

নির্মূল কমিটি কোন রাজনৈতিক দল নয়

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ২৮ মে ২০১৭

নির্মূল কমিটি কোন রাজনৈতিক দল নয়

’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দল জামায়াত। এই দলের অনেকেরই যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের মূল নেতা গোলাম আযমকে তার বয়স বিবেচনায় যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। আর কুখ্যাত সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল মৃত্যুদ-। তারপর পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির-বিএনপির মিথ্যা প্রচারণা- ‘সাঈদী এমন ফেরেশতাসম মানুষ যে তাকে চাঁদে দেখা গেছে’, চাঁদের ফটোতে সাঈদীর ফটো সুপারইমপোজ করে গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষকে সে ছবি মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে দিয়ে এমন অদৃষ্টপূর্ব বর্বরতা, তা-ব, অগ্নিসংযোগ, আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী-হত্যা করা হলো যে তার একটি প্রভাব বিচার প্রক্রিয়ার ওপর পড়েছিল বলে ধারণা করা হয় এবং সে কারণে আপীলে সাঈদীর সাজা হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। এই দেশ বিধ্বংসী নাশকতা, মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালানো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতাকর্মী হত্যার ঘটনাটিকে চরম অপরাজনৈতিক পন্থায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের কর্মকা- গণ্য না করার উপায় নেই। আপীলে এই উত্তরবঙ্গ জুড়ে তা-ব, খুনের দায় সাঈদীর ওপর চাপানো উচিত ছিল, কেননা তার দল তার স্বার্থে এ নাশকতা ও খুন সংঘটিত করেছিল ফলে বিচার ব্যবস্থাকে, আদালতকে অবমাননা করেছিল। এটি করা হলে, আপীলে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হলে এবং তা-বকারীদের, খুনীদের বিচারে সোপর্দ করলে, তা-বকারী খুনীরা নতুন করে সক্রিয় হতে পারত না বলেই জনগণ মনে করে। এখানে জামায়াত-শিবির-বিএনপি রাজনীতির নামে সুস্পষ্টভাবে অপরাজনীতি করেছে। সম্প্রতি সাঈদীর রিভিউ মামলাটি আদালতে দু’দিন সরকার ও আসামি পক্ষ সওয়াল করেছে। রিভিউতে আপীলের রায়ই বহাল থাকে, কিন্তু এ মামলার আপীলটি সংঘটিত হয়েছিল দেশব্যাপী তা-ব, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নাশকতার প্রেক্ষাপটে। সে কারণে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত দ-, যে অপরাধের জন্য সাঈদীর ফাঁসির দ- হয়েছিল, সে হত্যার ঘটনাগুলো অন্য যুদ্ধাপরাধীদের হত্যার জন্য ফাঁসির দ-ই হতে পারে- এমন আশা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের। আইন তো পূর্বের একই ধরনের অপরাধের দ-কে উদাহরণ হিসেবে অনুসরণ করে- এমনই জানা ছিল সবার। সে কারণে অন্য দেশের রায়ও আরেক দেশের আদালতে উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, আইন-আদালত নিরপেক্ষ, তা কেবল অপরাধের মাত্রা ও ধরনকে গণ্য করে। এবং সে জন্য আমাদের ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের বিচারে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল এতটা অনুসরণযোগ্য হয়েছে। এবং আমাদের ট্রাইব্যুনাল প্রথমবারের মতো ধর্ষণকে গণহত্যার সমান অপরাধ গণ্য করেছে। এ হিসেবে বাংলাদেশের জন্মের বাধাদানকারী শত্রুর দ- তার দলের অন্য সাঙ্গোপাঙ্গদের সমান হলে জামায়াত, শিবির, নব্য জেএমবি, তাদের মিত্র বিএনপির একটি অংশ হতাশ হয়ে পড়ত এবং নতুন উদ্যমে তা-ব চালাতে তারা সক্রিয় ও উৎসাহী হতো না বলেই জনগণের বিশ্বাস। এটা ঠিক, পুলিশ, র‌্যাব একের পর এক জঙ্গী গোষ্ঠীকে শনাক্ত করছে, তাদের সিংহভাগ নিহত হয়েছে, তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে, হচ্ছে- এটি একটি বড় সফলতা। কিন্তু যতদিন দেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আশ্রয়, প্রশ্রয়, জঙ্গীদের ব্যবহার করার প্রবণতা বর্তমান থাকবে, ততদিন দেশে জঙ্গী নির্মূল সম্ভব নয়- এটি একটি বড় সত্য। এখন আসা যাক ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সদস্য যারা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাদের সমালোচনার বিষয়টিতে। প্রথমেই বলতে হয়- ‘নির্মূল কমিটি’ নামের মধ্যেই এর উদ্দেশ্য নিহিত ও প্রকাশিত। দেশের সব শিক্ষিত মানুষের জানা আছে যে, ’৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের নেতা গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে ‘গণআদালত’ অনুষ্ঠিত হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ’৭১-এর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে। এই কমিটিতে যুক্ত ছিলের দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক-কবি-সাহিত্যিক। প্রায় লক্ষাধিক নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর-তরুণ সেদিনের সেই জনসমাবেশ ও গণআদালত থেকে নতুন আশায় বুক বেঁধেছিল যে একদিন ঐ স্বজন হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের অসম্পন্ন বিচারটি অনুষ্ঠিত হবে। দেরিতে হলেও কোন একদিন এই বিচার হবে- এ স্বপ্ন জনগণকে নির্মূল কমিটি দেখিয়েছিল সেদিন। দ্বিতীয়ত: জনগণ জানে যে- নির্মূল কমিটি একটি অ-রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন যার মূল কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংবিধানের চার মৌলনীতি রক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা। তৃতীয়ত: যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার কাজটি ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পর সামরিক শাসনের মাধ্যমে শুরু হয়। জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর প্রদত্ত সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে তাদেরকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে তাদের ক্ষমতা প্রদানের কাজটি শুরু করে। তার মৃত্যুর পর, এরশাদ, খালেদা জিয়ার আমলে জামায়াত-শিবির জঙ্গী মৌলবাদী দলের জন্ম দেয় যারা ’৭১-এর মতোই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, মুুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ হত্যা শুরু করে। নির্মূল কমিটি এইসব সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে কাজ করে, আর্থিক ও আইনী সহায়তা দেয়। তাছাড়া, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি নির্মূল কমিটির একটি অন্যতম দাবি। চতুর্থত: নির্মূল কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছে আইনজীবী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিকসহ নানা পেশার নারী, পুরুষ, তরুণ, তরুণী এবং বিশেষত শহীদ পরিবারের স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র। নির্মূল কমিটি বীরাঙ্গনাদের সমাজের কাছে তাদের বিশাল ত্যাগের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতে বার বার বীরাঙ্গনাদের সভা-সমাবেশে নিয়ে এসেছে, তাদের কথা শুনেছে, আর্থিক সাহায্যও সীমিত আকারে করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের কাছে তাদের অবদানের স্বীকৃতি দাবি করে এসেছে। পঞ্চমত: সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি নির্মূল কমিটি করে চলেছে, সেটি হচ্ছে- দেশকে চিরতরে যুদ্ধাপরাধীদের আদর্শমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সরকারের কাছে কতগুলো সুনির্দিষ্ট দাবি জানাচ্ছে- ১. দেশের সব জেলার সব বড় বড় যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা ২. সব যুদ্ধাপরাধীর সম্পদ, যা ‘৭১-এর লুটপাট দ্বারা অর্জিত সেসব বাজেয়াফত করে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা ৩. মুক্তিযুদ্ধ অবমাননা বা বিতর্কিত করার বিরুদ্ধে আইন করা ৪. ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা যেটি সরকার সম্প্রতি করেছে ৫. ‘৭১-এর বধ্যভূমি চিহ্নিত করে তাতে স্মারক তৈরি করা ৬. সকল বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা গণ্য করে সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করা এবং তাদের তালিকা প্রণয়ন করা ৭. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, টক শো, মুভি, লিফলেট, বুকলেট ইত্যাদির মাধ্যমে অব্যাহতভাবে প্রচারণা পরিচালনা করা এখন কথা উঠেছে, নির্মূল কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর বা অন্য কোন পদে থাকা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে কিনা। যেহেতু নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারে নিয়োজিত একটি সামাজিক সংগঠন, যেহেতু এ রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে জন্ম নিয়েছে এবং যার সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনের পক্ষে আইন প্রণয়ন করার নির্দেশ দিয়েছে, এসবই নির্মূল কমিটি পুরোপুরি মেনে কাজ করে। সুতরাং এ কমিটির সদস্যরা প্রমাণ করে যে তারা রাষ্ট্রবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ বা সমর্থক নয় বরং তারা মুক্তিযুদ্ধের মৌলনীতিতে বিশ্বাসী। এরাই তো এ দেশের নাগরিক থাকার কথা, তাই নয় কি? নতুবা, কোন যুদ্ধাপরাধীর সমর্থক কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে থাকতে পারে? যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চয় যুদ্ধাপরাধী সমর্থক কোন ব্যক্তি হতে পারে না। সর্বোপরি, নির্মূল কমিটি রাজনীতি করে না, নির্বাচন করে না, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ আজ পর্যন্ত নির্বাচনে দাঁড়ায়নি। টেকনিক্যাল ব্যক্তি হিসেবে সরকারের ইচ্ছায় একজন আইনজীবী মন্ত্রী হয়েছিলেন। যতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী কার্যক্রম নীতি বাস্তবায়ন এ দেশে অসম্পন্ন থাকবে ততদিন নির্মূল কমিটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সক্রিয় থাকবে। এই আগত, অনাগত সদস্যদের কেউ সরকারের ইচ্ছায় মন্ত্রী বা অন্য কোন পদে নিযুক্ত হয়ে কাজ করবে- এটাই স্বাভাবিক। প্রধান বিচারপতি বিচক্ষণ ও দক্ষ ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয় জানেন কোন মুক্তিযোদ্ধা তার পিতার হত্যাকারী, বোনের ধর্ষকের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না- যেমন খুনী ও খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনের মধ্যে আমরা এই অসম্ভব ঐক্য কখনও আশা করি না। বরং ঐ ঐক্য যদি হয় তবে তাকে ঘৃণা করি, বর্জন করি। তা না হলে অপরাধীর দ- ও অপরাধের শিকার ব্যক্তি সুবিচার পাবে কিভাবে? আদালত, আইন তার অস্তিত্ব বজায় রাখবে কি করে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরাই তো বিচারিক আদালতে নিযুক্ত হবে, তাই নয় কি? আমাদের দুঃখ আমরা একজন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের, বিকাশের, অস্তিত্বের শত্রু, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি দেইল্লা রাজাকারের ফাঁসির মধ্যে দিয়ে ’৭১-এর কলঙ্ক মোচন করতে পারলাম না। পারলাম না একজন সাহসী বীরাঙ্গনা, যোদ্ধা ভগীরথীর নির্মম হত্যাকা-ের এক হোতার বিচার করতে। ভগীরথী তার সব দিয়েও পেল না তার খুনী নির্যাতকের বিচার! এটি আমাদের জন্য মর্মান্তিক দীনতা, কেননা আমরা ভগীরথীকে তার প্রাপ্য সুবিচার দিতে পারিনি। আইনের দীর্ঘ হাত ভগীরথী, শত শত হিন্দু হত্যার, জবরদস্তি ধর্মান্তর, দেশান্তরকরণের প্রধান অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে অপরাধীর কাছে পৌঁছাতে পারলাম না- এই দুঃখ ও অপরাধবোধ আমরা যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন আমাদের শোকার্ত রাখবে। তবে, বীরযোদ্ধা ভগীরথী কি বিস্মরণের ধুলায় হারিয়ে যাবে? পিরোজপুর উপজেলার সেই রাস্তার একটির অথবা চৌমাথার নামটি ‘ভগীরথী চৌমাথা’ রেখে সরকার ও উপজেলা পরিষদ জাতিকে কৃতজ্ঞ করতে পারে- এ আশাটি নিশ্চয় আমরা করতে পারি।
×