ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ মাতা-কন্যাদের লড়াই

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২৮ মে ২০১৭

একুশ শতক ॥ মাতা-কন্যাদের লড়াই

১৭ সালের মার্চের মাঝে আমি নতুন এক বাংলাদেশ আবিষ্কার করেছি। শুরুটা কিশোরী জান্নাতুল ফেরদৌসকে দিয়ে। সেগুনবাগিচার ছোট একটি গলি দিয়ে যাবার সময় আমার সঙ্গে জান্নাতুলের পরিচয়। রাস্তায় বসে জান্নাতুল বই খাতা কলম নিয়ে পড়ছিল। সচরাচর এমন দৃশ্য কোথাও চোখে পড়ে না। এর আগে আমরা বিদ্যাসাগরের গল্প জেনেছি। আমি কলকাতার রাস্তায়ও এমন শিশুদের লেখাপড়া করতে দেখেছি। ধানম-ি লেকে যখন হাঁটতাম তখনও একাধিক শিশুকে ল্যাম্পপোস্টের নিচে লেখাপড়া করতে দেখেছ্।ি তখন ক্যামেরা ছিল না বলে ছবি তুলতে পারিনি। কলকাতার ধর্মতলায় শিশুদের ছবি তুলতে গিয়ে তিরস্কার পেয়েছিলাম। ওরা বিরক্ত হয়েছিল। তবে জান্নাতুল হাসি মুখে আমাকে সহায়তা করেছে। জান্নাতুলের শরীরের নিচে ছিল গরম পিচ। সে দিনেই পড়ছে- কারণ রাতে তো বিদ্যুত থাকে না। হারিকেনের আলোয় তিন ভাইবোনের লেখাপড়া করা প্রায় অসম্ভব। জান্নাতুলের কাছে গিয়ে জানলাম এই বাংলার অসাধারণ সফলতার কাহিনী। জান্নাতুলের এককালীন পৈত্রিক বাড়ি ছিল নেত্রকোনার পূর্বধলায়। সব হারিয়ে বাবা আলী আকবর সেগুনবাগিচার বস্তিতে কাগজ কুড়িয়ে সংসার চালায়। মা জাহানারা ভিক্ষা করেন- কারণ তিনি আর কোন কাজ করার ক্ষমতা রাখেন না। আমি যেদিন জান্নাতুলকে দেখতে যাই সেদিন জান্নাতুলদের মা জাহানারাকে পাইনি। তিনি ভিক্ষা করতে বাইরে ছিলেন। মা-বাবা তাদের ৪টি সন্তানের বড় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছেন। দুটি ছেলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে এবং জান্নাতুল ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। জান্নাতুলই জানাল তার দুই ভাই ও সে নিজে পঞ্চম শ্রেণীতে জিপিএ ৫ পেয়েছে। আলী আকবর ও জাহানারা প্রায় না খেয়ে তিন সন্তানকে পড়ান। এমনকি কোচিংও করান। আমি ওদের ছবিসহ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবার পর বেসিসের এক তরুণ সদস্য জান্নাতুলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। জান্নাতুল ডাক্তার হতে চায়। যিনি জান্নাতুলের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি তাকে ডাক্তারই বানাবেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জান্নাতুলকে বস্তি থেকে একটি নিরাপদ আবাসনে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি স্মরণ করতে পারি, ষাটের দশকে আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি তখন স্কুলে আর যাকেই পাওয়া যাক- মেয়েদের পাওয়া যেত না। প্রাথমিক স্তর অবধি মেয়েরা কেউ কেউ পড়লেও হাইস্কুলে পড়ার আগে ধনী পরিবারের মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে যেত। ৬৮ সালে আমি আমার গ্রামে ক্লাস সিক্সে সাকুল্যে ৬ জন ছাত্র পেয়েছিলাম-একটিও মেয়ে পাইনি। সেই দেশে মাত্র অর্ধ দশকের ব্যবধানে দিন মজুর বা ভিখারিণীর মেয়ে কেবল পড়ছে না-বাবা মা তাকে কোচিংও করাচ্ছে! সালাম বাংলাদেশ। এই ঘটনার দুদিন পর বেসিস অফিস থেকে হেঁটে বাংলা মোটর আসার পথে দেখা হলো একটি পান বিড়ির দোকানের যুবতী নাজমার সঙ্গে। সোনারগাঁও হোটেল পার হবার পর হাতিরঝিলের লাগোয়া ফুটপাথের কোণার পাড়ে পান-বিড়ির দোকানটি। আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করল নাজমার সামনের একটি শিশু। সে মার দিকে তাকিয়ে হাসছিল আর কাঠের শীল পাটায় মিছেমিছি মসলা বাটছিল। দুটি ছবি তুলে নাজমার সঙ্গে কথা বলে জানলাম সে স্বামী পরিত্যক্ত। দুনিয়ার আর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে তার ঠাঁই হয়েছে মায়ের কাছে। মা এই পান বিড়ির দোকানটি চালিয়ে নাজমাকে বুকে ধারণ করেন। সঙ্গে রয়েছে নাজমার তিনটি সন্তান। বড় দুটি স্কুলে পড়ে। নাজমাও কাজ পেলেই মাকে সহায়তা করে। কিন্তু তার সমস্যা কাজের পরিবেশ। শ্যামলা মুখশ্রী আর যৌবন নিয়ে কোথাও কাজ করতে গেলে স্বামী পরিত্যক্ত মেয়েটি অস্বাভাবিক হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়। চাকরি ছাড়তে হয় অতি দ্রুত। সবাই এই যুবতী মেয়েটির অসহায়ত্বের সুযোগ নেবার চেষ্টা করে। তারপরও নাজমার স্পষ্ট উচ্চারণ, আমার তিন সন্তানই লেখাপড়া করবে। তাদের বাবা সামান্য খবরও নেয় না- তবুও নাজমার দৃঢ়তা চমকে দেবার মতো। যে মেয়েটি খেলছিল সে মেয়ে শিশু। নাজমা হাসতে হাসতে বলল, আমার মেয়েটিও ডাক্তার হবে। নাজমার মা স্পষ্ট করে জানালেন, আমি থাকতে আমার নাতি-নাতনির লেখাপড়া বন্ধ হবে না। আমার মেয়ের গায়েও একটি আঁচড় পড়বে না। আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম নাজমার মার কথা শুনে। কারণ, বাংলাদেশের মায়েদের কি এটি একেবারে বাধ্যবাধকতা যে কন্যা বিধবা হলে, তালাক দিলে বা পেলে কিংবা স্বামী ছেড়ে গেলে তার আশ্রয়টা মায়ের কাছেই হতে হবে। আমার চারপাশে এমন অসংখ্য মাকে দেখছি আমি। তারা হয়ত নাজমার মতো এতটা অসহায় নয়-তবে সমাজ তাদের যে চরম হয়রানি করে সেটি সর্বত্রই প্রায় একই রূপের। তবুও নাজমাদের সালাম। সালাম বাংলাদেশকে। এরপর যে মহীয়সী নারীর সঙ্গে দেখা হয় তিনি জেসমিন বা ফাতেমা। জেসমিন আক্তার ফাতেমা, মাঝ বয়সী মা। চট্টগ্রামে ৬/৭ বছর ধরে একমাত্র মহিলা রিকশাচালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ফাতেমা খালা নামেই অধিক পরিচিত তিনি। সম্ভবত দেশের একমাত্র মহিলা রিকশাচালকও তিনি। স্বামী আরেকটি বিয়ে করে সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ায় সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেন তিনি। রিকশা চালিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এই সাহসী নারী। তিনি নারীদের পেশাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একদম পুরোপুরি পুরুষের পেশা গ্রহণ করেছেন। অসংখ্য পুরুষের ভিড়ে ভড়কে না গিয়ে সাবলীলভাবে তার জীবনচলা মুগ্ধ করে অনেককে। তার স্বামী যখন তিন সন্তানসহ তাকে পরিত্যাগ করে তখন তার নিজের কোন সক্ষমতা ছিল না। নিজে কোনদিন ঘর সংসারের বাইরে তিনি কিছুই করেননি। বাসায় বাসায় কাজ করে নিজেদের খাওয়া পড়া ছাড়াও সন্তানদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি চট্টগ্রাম শহরে রিকশা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। পুরো দেশে আর কোন মহিলাকে শহরের প্রকাশ্য সড়কে রিকশা চালাতে জানি না আমরা। তিনি এখনও চট্টগ্রামে রিকশা চালান। বড় ছেলেটাকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ান। কিন্তু ছেলেটি পরীক্ষা দেয়নি। বরং মাকে সহায়তা করার জন্য একটি কারখানায় কাজ নিয়েছে। ছোট দুটি ছেলেও এখন আর পড়াশোনা করে না। সন্তানরা মনে করে মা আর ভাইয়ের ফলে চাপটা অনেক বেশি। বরং ১৪ বছর বয়সেই ওরা এখন চাকরি করছে। জেসমিন প্রথম দিকে রিকশা চালিয়ে ভালই চলছিলেন। তার কষ্টের বিষয়টা ফেসবুকের মাধ্যমে জেনে তাকে একটি রিকশাও উপহার দেয়া হয়েছিল। দেশ বিদেশের অনেকে তাকে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে যে, সেই রিকশাটা ৪ মাসের মাথায় চুরি হয়ে যায়। এখন তাকে ভাড়ার রিকশা চালাতে হয়। দিনে ৩৫০ টাকা রিকশার মালিককে দিতে হয়। এরপর ৩/৫ শ’ টাকা তার থাকে। কিন্তু এই টাকায় ৪ জনের সংসার চলে না। বরাবরই স্বাধীনভাবে চলার পক্ষে ফাতেমা। অন্যের বাড়িতে কাজ করা কিংবা গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে পেশাও তার পছন্দ নয়। প্রথমদিকে প্যাডেলচালিত রিকশা চালালেও গত ৪ বছর ধরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। চট্টগ্রামের ওয়্যারলেস এলাকায় বাসা ভাড়া করে একাই থাকেন ফাতেমা। আর তিন ছেলে থাকে কুমিল্লার চান্দিনাতে মামার বাড়িতে। বড় ছেলে রুবেল (১৮) এসএসসি পরীক্ষার আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একটি ওয়ার্কশপে কাজ শিখছে। আর ১৫ বছর বয়সী জমজ ভাই হাসান ও হোসেন পড়াশোনা ছেড়ে বেকার। আমার দেখা মেয়েদের মাঝে নাজমার জন্য এখনও আমরা তেমন কিছু করতে পারিনি। তবে জান্নাতুলকে একটি ঠিকানা দিতে পেরেছি আমরা। এরপর আমাদের তালিকায় আসে জেসমিন ফাতেমা। ১৭ সালে বেসিস নারী ফোরাম যখন নারী দিবস উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন মার্চের ২৬ তারিখকে স্মরণ করে ২৬ জন কর্মজীবী নারীকে সম্মাননা দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরকারের সচিব, পাইলট, পুলিশ, ডাক্তার, শিক্ষাবিদ, নার্স এমন ২৫ জনের সঙ্গে আমরা পত্রিকায় ছবি দেখা ফাতেমাকেও সম্মাননা দেবার সিদ্ধান্ত নিই। চট্টগ্রাম থেকে খুঁজে বের করে ১৫ মার্চ আমরা তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সেলিব্রিটি হলে আনতে পারি। আমি ফাতেমাকে এর আগে কেবল ছবিতে দেখেছিলাম। সম্মাননা দেবার সময় অনুভব করলাম সেলিব্রিটি হলের পরিবেশে একেবারে জবুথবু হয়ে পড়েছিলেন তিনি। মঞ্চে ওঠার সময় তার শরীর কাঁপছিল। বেসিসের সভাপতি হিসেবে আমারই দায় তাকে মঞ্চে আনার। সেটি করতে গিয়ে সিঁড়িতে তার হাত ধরার পর তিনি মঞ্চে পা রেখেই আমাকে একেবারে পা ছুঁয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরলেন, আমার বাবা, আমার বাবা, বলে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি নিজে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে মঞ্চে আনার পর প্রথমে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলককে তিনি জড়িয়ে ধরেন এবং তারপর ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হককেও জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। আনিসুল হক তাকে সম্মাননাটি হাতে তুলে দেন আর আমি তাকে পরিয়ে দিই একটি উত্তরীয়। উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানান। অনুষ্ঠানতো বর্ণাঢ্য হয়েছিল। নারীদের-অতিথিদের সেলফিতে পুরো হলরুম কাঁপছিল। নারী দিবস নিয়ে এমন সুন্দর অনুষ্ঠান বাংলাদেশে তো বটেই অন্য কোথাও হয়নি-মন্তব্য ছিল মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটের। তার মাঝে এমন জায়গায় জীবনের প্রথম নৈশভোজ সারেন তিনি। অনুষ্ঠানের আলো নিভে যাবার পর বেসিস ভাবল কেবল একটি সম্মাননাই নয়, ফাতেমাকে আমরা আরও সহায়তা করতে চাই। পরের দিন বেসিস সিদ্ধান্ত নিল যে তাকে প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা দেয়া হবে। আমি নিজের হাতে সেই টাকা তার হাতে তুলে দিলাম। জীবনে এত কম টাকা পেয়ে কাউকে এত আনন্দিত হতে দেখিনি। ফাতেমা আবার আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বাবা ডাকল। টাকা পাবার পর সে এই টাকা দিয়ে কি করবে তার জবাবে সে জানাল, বেসিস থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে একটি দোকান চালু করতে চান তিনি। তবে এই টাকা যথেষ্ট নয় বলে তিনি জানান। একটি দোকানের ব্যবস্থা করে দিলে তিনি আর রিকশা চালাবেন না বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি ছেলে তিনটির জন্য উপযুক্ত ভাল চাকরি দেয়ার জন্যও সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। ফাতেমার এই সংগ্রামী জীবনের সঙ্গী আমরা হতে পারি। আমি বেসিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তারা তার পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। বেসিস নিঃসন্দেহে ফাতেমার পাশে থাকবে। তবে কে ফাতেমার পাশে থাকবে বা থাকবে না তার চাইতে বড় বিষয় অসম সাহসিনী ফাতেমা নিজেই নতুন মাইলফলক তৈরি করেছেন। ফাতেমা বলতেই পারে-আমরা করব জয়। জান্নাতুল বা নাজমাও একই কথা বলতে পারে। ঢাকা, ২৬ মে, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স, ওয়েবপেজ : িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ
×