ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে অগুনতি ফিটনেসহীন গাড়ি

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২৭ মে ২০১৭

যশোরে অগুনতি ফিটনেসহীন গাড়ি

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোরের বিভিন্ন রুটে চলাচলের অনুপযোগী বিভিন্ন যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সারাদেশে এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান চললেও কার্যত যশোরে তেমন কোন অভিযান চোখে পড়ছে না। এতে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির অবাধ চলাচলে একদিকে যেমন যাত্রীরা দুর্ঘটনার ঝুঁঁকিতে পড়ছেন, অন্যদিকে যশোর বিআরটিএ প্রতিবছর প্রায় অর্ধকোটি টাকার সরকারী রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি যশোরের বারীনগরে একটি ফিটনেসহীন গাড়ি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে। যাতে বহু হতাহতের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে। অথচ, এসব বিষয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের। বিআরটিএ সূত্র জানায়, যশোরে প্রায় ৯ হাজার নিবন্ধিত বাস, মিনি বাস, ট্রাক, মিনি ট্রাক, পিকআপ চলাচল করছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার যানবাহন রয়েছে ফিটনেসহীন। বিষয়টি নিশ্চিত করে যশোর বিআরটিএ অফিসের মোটরযান পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা খেলাপীদের প্রতিনিয়ত তাগিদ দেই। তবে অধিকাংশই আসেন না। অথচ, মোটরযান আইন বলছে, যানবাহনের ফিটনেস সনদ পাওয়ার মূল শর্ত হচ্ছে কারিগরি ও বাহ্যিকভাবে চলাচলের উপযোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে যানবাহনের ৬০টির মতো কারিগরি ও বাহ্যিক পরীক্ষা নেয়া হয়। এসব বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যানের ইঞ্জিনের পুরো কার্যকারিতা, আকৃতি ও নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা ওজন ঠিক আছে কি না, কালো ধোঁয়া বের হয় কি না এবং ব্রেক, লাইট ও বাহ্যিক অবয়ব ঠিক আছে কি না। এসব বিষয় নিশ্চিত হলেই ফিটনেস সনদ দেয়ার নিয়ম। বিআরটিএর হিসেবে যশোরের ৫০ শতাংশ যানবাহনেরই ফিটনেস সনদ নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, খালি চোখে দেখলেই মনে হয় যশোরে যানবাহনের ৬০ শতাংশই অনুপযুক্ত। ফিটনেস দেয়ার পদ্ধতিতেও গলদ রয়েছে। সড়কে আইনের প্রয়োগও কম। যশোরে যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই যেমন সত্য, তেমনি যেসব যানের সনদ আছে, যন্ত্রে পরীক্ষা হলে সেগুলোর একটা বড় অংশই চলাচলের উপযুক্ততা হারাবে। তারা আরও বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলার পেছনে কতগুলো কারণ আছে। বিআরটিএর একশ্রেণীর কর্মকর্তা ঘুষ নিয়ে অনেক সময় যানবাহন না দেখেই সনদ দিয়ে দেন। আবার কখনও কখনও বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে সনদ না নিয়েই মালিকেরা রাস্তায় গাড়ি নামাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে তাদের অভিমত, পুলিশ সড়কে কঠোর অবস্থান নিলে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল কমে যাবে। সূত্র জানায়, ফিটনেসবিহীন যানের বড় অংশ চলছে যশোর ও এর আশপাশের উপজেলাতে। আর কিছু চলছে দূরের পথে। জনসাধারণের জন্য বিশেষ করে বাসের ব্যবহারটিই বেশি। সে ক্ষেত্রে যশোরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা যায়, যশোর নিউমার্কেট থেকে মাগুরা রুটে, মনিহারের সামনে থেকে মনিরামপুর, কেশবপুর, নড়াইল স্ট্যান্ড থেকে নড়াইল, লোহাগড়া, কালনা, বাঘারপাড়া, যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ছুটিপুর, চৌগাছা, বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ বেশকিছু রুটে যেসব বাস চলাচল করে তার অধিকাংশ বাসের ফিটনেস সনদ নেই। তাছাড়া বিভিন্ন ট্রাকস্ট্যান্ডে থাকা অধিকাংশ ট্রাকগুলোর একই হাল। এসব যানবাহনের মালিকেরা নিবন্ধনের পর আর কোনদিন ফিটনেস সনদ নেইনি। আবার কোন কোন যানবাহনের নিবন্ধন সনদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তারা সনদ নেয়ার প্রয়োজনও মনে করেন না। এসব যানবাহনের ইঞ্জিনের অবস্থা শোচনীয়। গাড়ির রং চটা, অনেক বাসে সিটের বদলে বেঞ্চ, লুকিং গ্লাস নেই, লাইট জ্বলে, আবার জ্বলে না। দেদার বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া, যাতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ব্রেকে রয়েছে ত্রুটি। আর এভাবেই প্রতিদিন চলছে হাজার হাজার বাস-ট্রাক, পিকআপসহ নানা যানবাহন। এমনকি যশোরে এমন বাসও চলছে, যাদের কোন রেজিস্ট্রেশন প্লেট পর্যন্ত টাঙ্গানো থাকে না। সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে একটি ভেইকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) বিআরটিএর বিভাগীয় কার্যালয়ে বসানো হয়। ওই যন্ত্রের ওপর গাড়ি উঠিয়ে যান্ত্রিকভাবে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করে ফিটনেস সনদ গ্রহণ করার নিয়ম করা হয়। কিন্তু তা ২০০১ সালেই বিকল হয়ে পরে। তারপর ১৬ বছর পার হয়ে গেলেও ওই যন্ত্রটি সচল করতে পারেননি খুলনা বিভাগীয় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। বিআরটিএর অন্য এক সূত্র জানায়, ফিটনেস সনদ ফি বাবদ প্রতিবছরে বাস, মিনিবাস, ট্রাকের জন্য ১ হাজার ৬০৫ টাকা (ভ্যাটসহ) ও মিনিট্রাক, পিকআপসহ অন্যান্য যানের জন্য ১ হাজার ৮৭ টাকা (ভ্যাটসহ) নির্ধারণ করা রয়েছে। যশোর বিআরটিএর ভাষ্য মতে, প্রায় ৪ হাজার ফিটনেসবিহীন যান রয়েছে যশোরে। অথচ এসব গাড়ি থেকে ফিটনেস সনদ গ্রহন বাবদ কোন অর্থ সরকার পাচ্ছে না। সে হিসেবে ২ হাজার বাস, মিনিবাস, ট্রাক ধরলে বছরে ৩২ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং আন্যান্য যানবহন ২ হাজার ধরলে বছরে ২১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা আয় হতো। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর সর্বমোট ৫৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা সরকারী রাজস্ব খাতে জমা পড়ছে না। সে হিসেবে বলা যায় সরকার প্রতিবছর বিআরটিএর ফিটনেস ফি বাবদ প্রায় অর্ধকোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জানতে চাইলে বিআরটিএর যশোরের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি) সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, যশোরে যেসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে, তাদের ধরতে প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালানো হয়। এছাড়া এসব যানবাহনের ফিটনেস সনদ পরীক্ষা ও প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ঐক্য পরিষদের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের আহ্বায়ক ও যশোর বাস, মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ আলী আকবরের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, যশোরে যেসব বাসের ফিটনেস নেই সেসব বাসের তালিকা আমরা বিআরটিএর কাছে জমা দিয়েছি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। তিনি আরও বলেন, আমি ইতোমধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের মালিকদের লিখিত নোটিশ দিয়েছি। সেখানে উল্লেখ ছিল, গত মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে ফিটনেস সনদ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় সেসব গাড়ির কোন দায়ভার আমরা গ্রহণ করবো না। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে এসব গাড়ির মালিকদের এক লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছরের জেল এবং শ্রমিকদের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রেখে একটি আইন পাস হচ্ছে বলে নোটিশের মাধ্যমে তাদের অবগত করা হয়েছে।
×