ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নৌযান পেয়েছে গতি

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২৭ মে ২০১৭

নৌযান পেয়েছে গতি

সাগরপারের জেলা পটুয়াখালী। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর। তাছাড়া বুড়াগৌরাঙ্গ, রামনাবাদ, লোহালিয়া, পায়রা, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক, দাঁড়ভাঙ্গা, কুমারখালী, রামানন্দ, লাউকাঠি, বিষখালী, আগুনমুখা, সুবিদখালী, লেবুখালী, চাওরা, আড়পাঙ্গাশিয়া, আয়লা, গুলিশাখালী, বিঘাই, বুড়িশ্বর, চাকামইয়া, কচা, খাকদোন, কাজলসহ বেশ কিছু নদ-নদী এবং অসংখ্য খাল-উপখাল গোটা জেলাকে বেষ্টন করে আছে। সাগর ও নদ-নদীর কারণে চার-পাঁচ দশক আগেও পটুয়াখালী জেলা সারাদেশ থেকে এক প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানকার বাসিন্দাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। শহর বন্দর থেকে শুরু করে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে ব্যবহৃত হতো নৌকা। নৌকাকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘নাও’ বলা হয়। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হওয়ায় বৃহত্তর পটুয়াখালী অঞ্চলে হরেক রকমের নৌকা বা নাওয়ের দেখা মিলত। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য ছিল পৃথক নৌকা। যাত্রী বহনের জন্য প্রধানত একমালাই, ঘাষি, পানসি, ডোঙা, খেয়া, এক তক্তা, দুই তক্তা, তিন তক্তা, কেরায়, গয়না, কাঠামি, কোষা, বাছারি, টাকুইরা, পিনিস, ছৈ, কাথালি প্রভৃতি নৌকা বেশি ব্যবহৃত হতো। পণ্য পরিবহনের জন্য বেশি ব্যবহার হতো পাটের নৌকা, গোলের নাও, গুণটানা এবং বেপারি নাও। অগভীর পানির বিল বা ছোট ছোট খাল পাড়ি দেয়ার জন্য লোকজন কলাগাছ কেটে তা জোড়া দিয়ে তৈরি করতো ভেলা। যা কলার ভেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। ছিল তাল গাছের ডোঙা। দূরপাল্লার নৌপথে এক সময়ে বিভিন্ন ধরনের যাত্রীবাহী লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। স্টিমার অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। লঞ্চের সংখ্যাও ক্রমে কমে আসছে। ধনাঢ্য ব্যক্তি কিংবা সরকারী- বেসরকারী বড়কর্তারা এক সময়ে নৌপথে ‘স্পিডবোট’ ব্যবহার করতেন। এখন এর ব্যবহারও অনেক কমে গেছে। এর বাইরে গরু ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হতো। তবে তা একেবারেই হাতে গোনা। পালকিও ছিল। তাও সীমিত এবং অভিজাত বা ধনাঢ্য লোকজনরাই বেশি ব্যবহার করতো। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। চলছে হরেক রকমের যানবাহন। প্রত্যন্ত দ্বীপ-চর এবং পল্লী অঞ্চলেও এখন মিলছে ভাড়ায়চালিত মোটর সাইকেল। প্রতিটি মোটর সাইকেলে দুই-তিনজন যাত্রী বহন করা হয়। আছে বাই-সাইকেল। এক সময়ের ‘ভ্যান’ গাড়িতে এখন মোটর লাগিয়ে তা যান্ত্রিক যানে রূপান্তর করা হয়েছে। কাঠের তৈরি ভ্যান চলতো বাই-সাইকেলের চেইনের সাহায্যে। তাতে যাতায়াতে সময় লাগত বেশি। এখন তাতে ইঞ্জিন জুড়ে দেয়ায় এসেছে গতি। পানি সেচের পাওয়ার পাম্প মেশিন দিয়ে তৈরি হয়েছে ‘টেম্পো’। এতে অনায়াসে ১২-১৪ যাত্রী বহন করা হয়। টেম্পো দেশের অনেক এলাকায় ‘করিমন’ ‘নছিমন’ হিসেবে পরিচিত। এতে প্রচুর মালামালও পরিবহন করা যায়। ভারত থেকে আসা চার চাকার মাহিন্দ্র এ অঞ্চলে ‘ম্যাজিক’ গাড়ি নামে সমধিক পরিচিত। এতেও ১২-১৪ যাত্রী বহন করা হয়। পটুয়াখালী জেলার অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে এগুলো বেশ দাপটের সঙ্গেই চলে। এর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বিদ্যুতচালিত ‘অটো’। চিরায়ত কালের তিনচাকার রিকশাতেও সাম্প্রতিককালে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। এগুলোতে জুড়ে দেয়া হয়েছে বিদ্যুতচালিত মোটর। একবার মোটরের ব্যাটারীতে চার্জ দিলে কমপক্ষে ৬-৭ ঘণ্টা চলে। এর নির্মাণ খরচ বাড়লেও চালকদের আয়ও অনেক বেড়েছে। সাধারণ রিকশা তৈরিতে ১৫-২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। সেখানে বিদ্যুতচালিত রিকশা নির্মাণে খরচ কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার টাকা। চালকদের যাতায়াতে সময় লাগছে কম। তাতে যাত্রী বহন হচ্ছে বেশি। নৌযানেও এসেছে পরিবর্তন। এখন আর বৈঠা, পাল কিংবা গুণটানা নৌকার দেখা মেলে না। প্রায় প্রত্যেকটি নৌকায় ব্যবহার হচ্ছে পানি সেচের পাওয়ার পাম্প মেশিন। যাত্রী বহনের জন্য নৌপথগুলোতে চলছে হরেক রকমের ইঞ্জিনচালিত নৌকা। যা এলাকায় ‘ট্রলার’ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন আকার-আয়তন ও ঢংয়ে তৈরি হচ্ছে ট্রলার। দু-তিনশ যাত্রী কিংবা কয়েক শ’ মন পণ্য পরিবহন করা যায়, এ ধরনের ট্রলারেরও দেখা মিলছে। উপকূলের সাগর-নদীর জেলেরা এক সময়ে মাছ ধরার কাজে বিভিন্ন আকার-আয়তনের ‘ছিপ’ নৌকা ব্যবহার করত। এখন তাতেও লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। এখন প্রায় প্রত্যেকটি ছিপ নৌকাতেই ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। বৈঠা এবং পালের ব্যবহার নেই বললেই চলে। -শংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×