ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খালেদ রাহী

মানুষের গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৬ মে ২০১৭

মানুষের গল্প

আজকাল কত অদ্ভুত রোগের চিকিৎসা হয়। এই তো কিছুদিন আগেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘বৃক্ষমানব’ খ্যাত মানুষটির চিকিৎসা হলো। কি এক অদ্ভুত রোগ হাতে পায়ে বৃক্ষের মতো শিকড় গজায়। ডাক্তাররা বলেছেন, এ রোগের চিকিৎসা সফলতার দিকে। কিন্তু আফজাল হোসেনের রোগটা কোন সফলতার দিকে যাচ্ছে না। কি এক অদ্ভুত রোগ। সে বুঝতে পারে না রোগটা প্রথমত: দেহে ছড়ালো নাকি মনে। এ রোগের কোন লক্ষণও সে টের পায়নি। হঠাৎ করে রোগটা ধরা পড়ে। কেউ বলে এটা মানসিক রোগ, কেউ বলে ভ-ামি। আফজাল হোসেন মনে করে এটা চোখের দোষ। চোখে বোধহয় কুড়া পড়েছে; লোকে যাকে ‘ভলা’ বলে। চোখের রাজায় মাছের আমিষের মতো সাদা একটা বস্তু ভেসে বেড়ায়- আফজাল হোসেন ভাবে এ রকম কিছু হয়েছে। তার মনে পড়ে ‘ভলা’ বিষয়ক গল্পটি। গ্রামের এক কৃষক তাকে গল্পটি শুনিয়েছে। এক লোকের চোখে মাছের আঁশের মতো ‘ভলা’ পড়েছে। লোকটার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। পথ-ঘাট দেখতে অসুবিধা হয়। কিন্তু এ নিয়ে লোকটার কোন চিন্তা নেই। চোখের কচকচানি নিয়ে সে নীলাকাশের দিকে তাকায় আর ধেই ধেই করে নাচে। কারণ ‘ভলা’ পড়ার পর থেকে তার হাঁড়িপাতিল মাছে ভরে যায়। সে হাঁটু জলে জাল মারলেও হাঁড়ি হাঁড়ি মাছ উঠে আসে। কিন্তু আফজাল হোসেনের এ রোগ কোন মাছ, টাকা ডেকে আনে না। কেবল তাকে পথে-ঘাটে বেইজ্জুতি হতে হয়। অনেকে বলে তোমার জলাতঙ্ক রোগ হয়েছে। আফজাল হোসেন উত্তর দেয়, জলাতঙ্ক হবে কেন ? আমাকে তো কোন কুকুর কামড়ায়নি। লোক তার কথা বিশ্বাস করে না। আফজালও ঠেকায় পড়ে কয়েকটা প্রশ্নে উত্তর শিখে নেয়। এক. জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ কি? দুই. এ রোগের ইনজেকশনের আবিষ্কারক কে? তিন. এ রোগ প্রথমত: কোথায় দেখা দেয়? এসব প্রশ্নের উত্তর আফজাল হোসেনের কখনো কাজে লাগে কখনো কাজে লাগে না। মানুষ অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করে। কয়েকদিন আগে একজন প্রশ্ন করেছে- একটা কুকুর ডাকলে আরেকটা কুকুর ডাকে কেন? আফজাল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভেবেচিন্তে জবাব দেয়, বিপদের টের পেয়ে। লোকটা আবার পাল্টা প্রশ্ন করে- তাহলে এক ভাই বিপদে পড়ে ডাকলে আরেক ভাই আসে না কেন? আফজাল হোসেন ভেবে পায় না কি উত্তর দেয়া যায়। সে বুঝতে পারে না কুকুর বিষয়ক প্রশ্নে মানুষের টানাটানি কেন? লোকটা তাগাদা দিতে থাকে উত্তর দেন, উত্তর দেন। আফজাল হোসেন ভেবে দেখে উত্তর একটা দিতে হবে। না দিলে লোকটা তাকে ছাড়বে না। সে উত্তর দেয়, কারণ মানুষেরা কুকুর নয়। লোকটা হি হি করে হাসে। কিছুতেই তার হাসি থামে না। আফজাল হোসেন লজ্জা পেয়ে তার মুখের দিকে তাকায়। কুকুর কুকুর বলে চেঁচিয়ে উঠে। রোগটা মুনিয়ার মৃত্যুর কয়দিন পর দেখা দেয়। প্রথম প্রথম রোগটা নিয়ে আফজাল হোসেনের মাথাঘামানো ছিল না। রোগটা যখন তাকে ‘পাগল তকমা’ পরিয়ে দেয়, তখন সে রোগটা নিয়ে ভাবে। কিন্তু অসুখটা দিন দিন বাড়ছে। হয়তো সে সকালবেলায় দোকানে নাস্তা করতে গেল, দু’একজন লোকের সঙ্গে নাস্তাও করল- হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, কুকুর, কুকুর। কখনো কখনো মানুষের চেহারায় সে ছাগল, গরু ও কুকুর এসব প্রাণীকে দেখতে পায়। কখনো কখনো কুকুর, ছাগল ও গরু এসব প্রাণীকে সে মানুষ ভেবে ভুল করে। হয়তো সে হাটে গেছে- মাংসের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুর দেখে চেঁচিয়ে উঠল, কি সুন্দর মানুষ। লোকে বলে এ তার শাস্তি। মুনিয়া এক রাতে বমি করতে করতে মরে যায়। কিন্তু মানুষ বলে আফজাল তাকে মেরে ফেলেছে। কতবার যে সে বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে, কতবার যে কতভাবে জালিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো মুনিয়া দুপুরে ভাত রান্না করল, আর সে পুরো ভাত খেয়ে সাবাড় করে দিল। হয়তো মুনিয়া কিছু টাকা জমিয়ে রাখল আর সে তা চুরি করে গাজা খেল। আরও কতভাবে যে আফজাল হোসেন বউকে জালিয়েছে, পাড়া-প্রতিবেশী তার জ্যান্ত সাক্ষী। এসব ঘটনার পরও মুনিয়া স্বাভাবিক থাকত। নিচু গলায় বলত, বাবা আর কত টাকা দেবে? মায়েরও একটা পা অবশ হয়ে গেছে। বাবার অভাব তোমাকে বুঝতে হবে। আফজাল হোসেন মুনিয়ার কথাকে বাতাসে ছড়িয়ে দিত। ‘দেবে না কেন? টাকা দেবে না কেন?’ মুনিয়া চিৎকার করত না। স্বামীকে বলত, যত কিছুই কর মৃত্যুর পরও আমি তোমাকে ছায়া দিয়ে যাব। মুনিয়ার মৃত্যুর পরে ‘ছায়া দিয়ে যাব’ কথাটা আফজাল হোসেন বহুবার ভেবেছেন। কারণ আকাল তাকে নাকাল করে দিচ্ছিল। তার অভ্যাস সকালবেলায়ও গরম ভাত খাওয়া, গভীর রাতে চা খাওয়া। মুনিয়ার মৃত্যুর পরে সে এসব পাচ্ছিল না। ভাত রান্না করাও তার জন্য কষ্ট হয়ে পড়ে। বুড়ো মা যুক্তি দিয়েছিলেন আবার বিয়ে করতে। আফজাল হোসেনও সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু ঘরের পাশের এক চাচা বলল, একটা তো মেরে ফেলেছিস, বিয়ে করে আরেকটাও মারবি। চাচার কথায় সে বিয়ে নামক বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। না, মুনিয়ার পর সে আর বিয়ে করবে না। এ কথা সে মানুষকে নয়, উঠানের এককোণে পাতা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষকে বলেছে। কুকুর, বৃক্ষ এসবকে বলার অর্থ হিতাকাঙ্খিরা খুঁজে বেড়ায়- কিন্তু কোন কারণ খুঁজে পায় না। আফজাল হোসেনের এ অদ্ভুত রোগ নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর কৌতূহল কম নয়। বিশেষ করে বেকার ছেলে-ছোকরার দল। ওরা চায় আফজাল হোসেনকে দিয়ে ব্যবসা চালু করতে। তারা চৌরাস্তার মোড়ে পান সিগারেট আর চা খেতে খেতে প্রচার করে-আফজালের অলৌকিক চোখ আছে। সে ভবিষ্যত পড়তে পারে। জিনের বাদশা। তারা আরও বাড়িয়ে বাড়িয়ে গল্প বলে। আফজালের পানি পড়া উপকারী। আফজাল ফুঁ দিলে মানুষের কঠিন রোগ ভাল হয়ে যায়। কিন্তু সমাজের মান্যগণ্য বয়স্কদের কারণে ছেলেছোকরারা সুবিধা করতে পারে না। ফলে, তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিও আফজাল হোসেনকে পাহারার মধ্যদিয়ে রাখে। রাত নামলে উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা গাছে উঠে বসে থাকে ছেলেছোকরারা। ছায়া ছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে সমাজের দু’একজন বয়স্ক লোক। তারা শুনতে চায় আফজাল গাছের সঙ্গে কি কথা বলে। পাশের বাড়ির হাঁপানি রোগে আক্রান্ত বুড়িও সারারাত জেগে থাকে- আফজাল কুকুর বিড়ালের সঙ্গে কি কথা বলে শুনতে। তারা শুনে- ছায়া ছায়া আঁধার ঘিরে আফজাল হোসেন আমগাছকে বলে যাচ্ছে- মুনিয়া মুনিয়া তুমি আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছ। তারা দেখে অনেকগুলো কুকুর আমগাছের তলায় ভিড় করেছে। তারা ভাবতে পারে না এ পাড়ায় এতো কুকুর কোত্থেকে এলো। তারা শুনে- আফজাল হোসেন বলে যাচ্ছে, মুনিয়া আমাদের স্বাগতম জানাতে কত লোক এসেছে। দেখ দেখ। তারা দেখে- একটি বৃক্ষ, আফজাল হোসেন আর কতগুলো কুকুর। এসব দেখতে দেখতে তাদের রাত বাড়ে।
×