ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

মূর্ত বিমূর্ততায় ভাস্কর নভেরা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৬ মে ২০১৭

মূর্ত বিমূর্ততায় ভাস্কর নভেরা

বাংলাদেশের প্রথম সারির আধুনিক ভাস্করের কথা বললে একটি নাম উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- নভেরা আহমেদ। নভেরা আহমেদ সৃজন সময়ের চেয়ে ছিলেন বেশ অগ্রসর। তার সৃষ্টিকর্ম বিকশিত হয়েছে তারই বুদ্ধির উজ্জ্বল দীপ্তিতে। তার শিল্পকর্মের মধ্যে এক ভিন্ন আঙ্গিক প্রতিফলিত হয়। সর্বদাই এক স্বাধীনচেতা স্বকীয়তার প্রতিফলনপরিলক্ষিত হয় তার কাজে। সম্পূর্ণভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায় তার ভাস্কর্য নির্মাণের বিষয়বস্তু, প্রকরণ ও প্রকাশভঙ্গিতে। কখনই বিন্দু পরিমাণ আপোস করেনি তার চিন্তাচেতনা কিংবা চলাফেরাতে। তিনি নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা নিজস্বতা রক্ষার্থে ছিন্ন করেছিলেন পরিবারের মায়ার বন্ধন। সাহসী আপোসহীন জীবনের বন্ধুর পথ বেছে নিয়েছিলেন একমাত্র ভাস্কর্যকে ভালবেসে। পাড়ি জমিয়ে ছিলেন বৈরী মুক্ত তার চিন্তাধারার সঙ্গে অনুকূল পরিবেশ বিদেশের মাটিতে। ইউরোপীয় শিক্ষা গ্রহণের ফলে আধুনিকতা বোধ সঞ্চার করেছিল তার সৃষ্টিতে। যা প্রথাচর্চা বহির্ভূত সমকালীন সঙ্কটকে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছিল পরম যতেœ তার ভাস্কর্যে তারই হাতের মাধুর্যে। তিনি বহেমীয় ঘরানার ছিলেন। ভাস্কর্যের প্রতি অতি আবেগীয় মনোবৃত্তির দরুন দুঃসাহসী এক অজানার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন ভাস্কর্যজ্ঞান আহরণের নিমিত্তে জীবনের শুরুতেই। সমকালীন মানুষের মর্মযাতনা ও আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধের আবেগটি অতি সার্থকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার ভাস্কর্যে। নব্যবঙ্গীয় শৈলীর শিল্পীরা ঐতিহ্যের সঙ্গে ধ্রপদী আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে ফিরে গেলেও নভেরা ঐতিহ্যের গড়নগুলোকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। মূলত আলঙ্কারিক ও স্বাতন্ত্র্যম-িত বিন্যাসে। যা তাকে দিয়েছে নিজস্ব সত্তা। ইউরোপীয় ভাবধারার সঙ্গে তিনি দেশীয় বিষয় ও টেকনিক মিলিয়ে কাজ করতেন। হেনরী ম্যুর, রঁদ্যা, এ্যাঞ্জেলোর কাজ তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে ভাস্কর হিসেবে নিজেকে গড়তে। তাদের প্রভাব পড়েছে নভেরার ভাস্কর্যে তবে অবিকল অনুকরণ নয়, নিজস্বতা বজায় রেখেই নিজ আঙ্গিকে নির্মাণ করেছেন তার স্বাধীন ভাস্কর্যগুলো আর যার দ্বারা তাকে স্বকীয় ভাস্কর হিসেবে ভাস্বর করেছে। দেশে থাকেননি জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন ভিন দেশে কিন্তু দেশকে ভোলেননি মুহূর্তের জন্যও। আর তার প্রমাণ মেলে নভেরার সৃষ্টিতে নির্বাচিত বিষয়ে। মায়ের টান, মাটির গন্ধ তাকে বিমোহিত করেছিল বলেও দেখতে পাই তার মূর্তি নির্মাণের বিষয়ে মা-শিশু, গরু-কৃষক, বাবা মা-পরিবার ইত্যাদি। যেগুলোর উপস্থাপন ঘটিয়েছেন মৌলিকতার সারল্যে। সরলতা এবং স্পেসের স্পষ্ট বিভাজন দুটি বিষয় একত্রিত হয়ে নভেরার ভাস্কর্যগুলোকে করেছে এত বেশি দৃঢ় ও শক্তিশালী। ব্যক্তি হিসেবে নভেরা যতটা স্বাধীন ছিলেন, মুক্ত ছিলেন তার সেই আবেগের বহির্প্রকাশ ভাস্কর্যে খুবই স্পষ্ট। ভাস্কর্যের মূল চরিত্র ভিজুয়াল সেনসেশন তৈরি এবং এন্ডলেস ইন্টারপ্রিটেশন তার স্বয়ংসম্পূর্ণ উপস্থাপন ঘটিয়েছেন অতি সার্থকভাবে। নভেরা তার শিল্পকর্মে কখনও একঘেয়েমির ছোঁয়া লাগতে দেননি, এমনকি তার একই বিষয়বস্তুতে করা কাজগুলোতে তিনি লন্ডন, প্যারিস ইতালিসহ বেশকিছু দেশে গিয়ে বিভিন্ন বিখ্যাত ভাস্করদের অক্ষয়র্কীতি কাজগুলো দেখার সুযোগ পান। ফলে তার ভাস্কর্যজ্ঞান ব্যাপক সমৃদ্ধি পায় তারই দক্ষতার স্বরূপ বহন করে নভেরার প্রতিটি সৃষ্টি। তিনি তার ভাস্কর্যগুলোর মাঝে গোলাকার গর্তের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। প্রকৃতির সঙ্গে একাগ্র করেছেন তার মুক্ত ভাস্কর্যগুলোকে এই স্পেসগুলো তৈরির মধ্য দিয়ে। তার অদ্ভুত সৃষ্টি হলো ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ যেটি তাকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার এনে দিয়েছিল। দশ বছরের এক ছেলের আবক্ষ মূর্তিতে আবেগের যে পরিপূর্ণ বহির্প্রকাশ তা সত্যিই বিমোহিত করে দর্শককে। চট্টগ্রামের রেকিট এ্যান্ড কোলম্যান অফিস এবং ঢাকার এ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সামনের লনে নভেরার দুটি কাজ আছে। দুটি সৃষ্টিই তিন ফুটের মতো উচ্চতা বিশিষ্ট্য এবং এর একটি সম্পূর্ণ বিমূর্ত ও অপরটি বিমূর্ত মাতৃমূর্তি। সিটেড ওমেন শিরোনামে তার বেশকিছু কাজ রয়েছে যেখানে কোলে শিশুকে দেখতে না পেলেও কোলের ব্যাপ্তি ও গভীরতা দিয়ে শিশুর অবস্থান এবং মায়ের স্নেহ-ভালবাসা ও দায়িত্বের ইঙ্গিতবহ উপস্থাপন অনুধাবন করা যায় সহজেই। কোনটাতে মাঝে একটি শিশু নিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দ-ায়মান থাকতে দেখা যায়। আবার কখনও মাকে অর্ধশায়িত অবস্থায় এবং তার কোলে তিনটি চঞ্চল শিশু প্রাণবন্তরূপে উপস্থাপিত। মা ও শিশুর কাজগুলোতে নভেরা লোকজ ফর্মের পুতুলের আদল ব্যবহার করেছেন যেগুলোকে আদিম উর্বরা মাতৃকা মূর্তির ন্যায় মনে হলেও তাতে আধুনিকতার ইঙ্গিতও রয়েছে সমপরিমাণে। বসা এবং দাঁড়ানো অবস্থার বেশ কিছু পুরুষ ও নারীদেহের ভাস্কর্য গড়েছেন তিনি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ ভাস্কর নভেরা আহমেদ তার ভাস্কর্যের বিষয় খুঁজতে চলে যেতেন বিষয়বস্তুর অনেক নিকটে নিরীক্ষা করতেন সেখানে অবস্থান করে ফলে তার সৃষ্টিতে বাস্তব এবং পূর্ণ আবেগের জীবন্ত আভা থাকত। তিনি প্রথম আধুনিক প্রাঙ্গণ ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। ‘কাউ এ্যান্ড টু ফিগার্স’ নামে যেখানে গ্রামবাংলার আবহ কৃষক ও তার নির্ভরশীলতা গরুকে উপস্থাপন করেছেন মাঝে ম্যুরের ন্যায় গোলাকার শূন্য স্পেস তৈরি করেন আলো ও দেশ পরস্পর সংযুক্তির সুযোগ পায় সেই নিমিত্তে। দ্য লং ওয়েট প্রতীক্ষার এক ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেন এই ভাস্কর্যে। আদিম মৌলিকতায় সরলীকরণ এবং মাতৃকামূর্তির চোখের চাহনীতে গভীরতা আছে, দুর্বলতা অসহায়ত্বের পরিবর্তে শক্তি বেদনার দৃঢ় মিশ্রণের মুখাভিব্যক্তির প্রকাশ এটি। বর্মা ভ্রমণের পর বৌদ্ধ বিষয়বস্তুতে আগ্রহের ফলে পিস শিরোনামে বেশকিছু কাজ করেছিলেন। ইউরোপীয় আধুনিক ভাবধারার সঙ্গে তিনি দেশীয় বিষয় ও টেকনিক মিলিয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন তৈরি করেন। বুদ্ধের আসন তৈরি করেন ঠিকই কিন্তু তাতে মানুষ বা মানুষের ব্যাপক কোন ফর্ম অনুপস্থিত। নভেরা তার নারী অবয়বের ভাস্কর্যে এনেছেন আর্তমানবতার প্রতীকরূপ। যেখানে নারীর শরীর প্রাধান্য পায়নি শরীরকে অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেছেন মাত্র। কিছু ভাস্কর্যে সমস্ত অন্তরাত্মা এবং আর্তিরূপে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন উর্ধপানে তাকানো ভাস্কর্যরূপে শান্তির আশা অথবা নির্বাণ লাভের আকাক্সক্সক্ষায় ব্রতী হিসেবে। নভেরা আহমেদ এদেশের ভাস্কর্যের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। তিনি না এলে এদেশের ভাস্কর্য আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে বেশ বেগ পেত। জনসাধারণের কাছে ভাস্কর্য বিষয়টি বোধগম্যতা পেত আরও বিলম্বে। ভাস্কর্যে অনন্য অবদানে পেয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংরাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক। নভেরা অর্থ নবাগত বা নতুন জন্ম। ভাস্কর্যের মাঝেই নিজের নাম দেখেছেন অর্থাৎ ভাস্কর্যকে সত্যিই তিনি নতুনভাবে জন্ম দিয়েছেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের অনুপ্রেরণা হয় এবং সব শিল্পোবোদ্ধার মানসপটে স্পষ্টরূপে বেঁচে থাকবেন সব সময়।
×