উন্নয়নের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের সাফল্য সারা বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ে দেশের সমৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। উন্নয়নের প্রত্যয়টিকে যদি আমরা বস্তুগত এবং চেতনাগত দিক থেকে ভাবি তাহলে বলতে হবে বস্তুগত উন্নয়নে আমরা নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের মন, মানসিকতা, চেতনা কিংবা মননের উৎকর্ষতা কতখানি হয়েছে তা অবশ্যই ভাববার বিষয়। সংস্কৃতিতে যেমন বস্তুগত এবং ভাবগত হিসেবে বিভাজন করা যায় তেমনি উন্নয়নের বিবেচনায় ও এই ব্যাপারটি আসা অত্যন্ত জরুরী। বহুতল ভবন, অত্যাধুনিক আসবাবপত্র, আধুনিক প্রযুক্তির সমস্ত আয়োজন কিংবা আরও বিলাসবহুল বাহারি জিনিসপত্রের ব্যবহারÑ এ সবই ধরে নেয়া যেতে পারে একজন মানুষের প্রতিদিনের উন্নত জীবনযাত্রার প্রাসঙ্গিক এবং পরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু সেটাই কি কোন মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের নির্ণায়ক? তার ভেতরের মানসিক প্রবৃত্তি কিংবা মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় যদি কোন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে প্ররোচিত করে তাহলে সমৃদ্ধির যথার্থতা কোথায় থাকল? আর বাস্তবে এটাই হয়। শুধু আজ নয় বহু আগের থেকেই মানুষের বস্তুগত এবং ভাবগত অসমতা মানুষকে সত্যিকার অর্থে আধুনিকও করেনি, উন্নতির শিখরেও পৌঁছে দেয়নি। গত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন বলেছিলেনÑ বস্তুগত সংস্কৃতি যেভাবে এগিয়ে যায় অবস্তুগত সংস্কৃতি ঠিক তেমনভাবেই পেছনে পড়ে থাকে। ফলে দুটোর মধ্যে একটি বিরাট ফারাক তৈরি হয় যাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন ‘সংস্কৃতির প্রতীকমূলক প্রত্যয়ের পশ্চাদবর্তিতা।’ আমরা আজও সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি বলে মনে হয় না। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধাংশ নারী। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আধুনিক-পিছিয়ে পড়া কিংবা গৃহিণী-কর্মজীবী নারীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা দেখে এর সত্যতা যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায়। এই নারী নির্যাতনের আর একটি ভিন্নমাত্রা গৃহপরিচারিকা নির্যাতনÑ যার সিংহভাগই নারী। সমাজের উঁচু শ্রেণীর বিত্তবান মানুষ কিংবা অনেকটা অবস্থাপন্ন পরিবারে নিয়োগ পাওয়া গৃহকর্মীদের ওপর অসহ্য উৎপীড়ন আর অত্যাচারের মাত্রা দেখলে মনে হয় আমরা সেই মধ্যযুগে কিংবা সভ্যতা বিবর্জিত অধ্যায়ে পুনরায় ফিরে গেছি। অত্যাধুনিক দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যমণি হয়ে বসে থাকলাম সেই বর্বর যুগের মনমানসিকতা নিয়ে। শিক্ষা কিংবা আধুনিকতার আবরণে নিজেকে নতুন করে সাজিয়েও ভেতরের পশুবৃত্তিকে কোনভাবেই ঠেকাতে পারলাম না কেন? যেভাবে গণমাধ্যমে এই গৃহকর্মীদের অত্যাচারের নমুনা দৃশ্যমান হয় তাতে যে কোন মানুষ শিউরে ওঠার কথা। সেখানে আর এক মানুষই সেই বীভৎস কাজটি করে থাকেন। গৃহকর্মী রাখার সৌভাগ্য সবার হয় না। যারা সক্ষম, আর্থিকভাবে যারা সচ্ছল, যারা গৃহকর্মী ছাড়া ১ দিনও চলতে পারেন না তারাই মূলত সংসারের কাজকর্মের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাসোহারার বিনিময়ে কাউকে নিয়োগ দেন। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। সংবাদ মাধ্যমে যেসব অত্যাচার-অবিচারের স্পষ্ট চিহ্ন প্রতিভাত হয়েছে তারা সবাই বালিকা কিংবা কোন কিশোরী। শরীরে গরম পানি ঢেলে দেয়া থেকে শুরু করে, গরম খুন্তির ছেঁকা, রুটির বেলুন দিয়ে মারধর করা এমনকি পর্যাপ্ত খাবার না দেয়ারও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলেছে এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এখানেও সিংহভাগ নির্যাতন করে সংসারের গৃহকর্ত্রী। তিনি নিজেও একজন নারী। শুধু নারীই নয়, মাতৃমহিমায় পরিশুদ্ধ একজন মাও বটে। মানবতার অপমান, বিবেকহীনতার অসংহত আচরণ, বন্যপশুর মনোবৃত্তি নিয়ে তার প্রতিমুহূর্তের সাহায্যকারীকে যেভাবে নৃশংসতার শেষ ধাপে নিয়ে যায় তা মূলত অমানবিক দাস প্রথার সঙ্গেই তুলনীয়। পারিবারিক এই সহিংস পরিস্থিতি কি সাংসারিক জীবনকে আদৌ সুস্থ রাখে? নিজের শিশুকন্যাটির সামনে যখন বালিকা গৃহকর্মীকে অত্যাচার করা হয় তাহলে তার সন্তানের মানসিক বিকাশ কিভাবে সম্ভব? নিপীড়নের বলি হয় শিশু এবং বালিকা মেয়েরা। এক সমীক্ষায় উঠে আসে ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ২৬ জন গৃহশ্রমিক। আহত হয়েছে ৪২ জন আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় ১৫ জন। জরিপে আরও জানা যায় ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে প্রায় ২০ লাখ গৃহকর্মী গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত আছে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে নির্দেশ দেয়া আছে ১২ বছরের নিচে কোন শিশুকে গৃহ থেকে আরম্ভ করে কোন শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে কাজ করাতে হবে অপেক্ষাকৃত হাল্কা। কিন্তু আইন না মানার ঔদ্ধত্যে আন্তর্জাতিক আইনও চরমভাবে লঙ্খিত হচ্ছে। নৃশংস ঘটনার অপরাধীরা ধরা পড়লেও শেষমেশ আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। সুতরাং বিচারহীনতার প্রক্রিয়াও অপরাধের মাত্রাকে নতুনভাবে উস্কে দেয়। শিশু নির্যাতন আইনে এসব অপরাধীর বিচারিক বিধান নির্ণীত থাকলেও তা নাকি আজ অবধি সফল হয়নি। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক আইনজ্ঞ সালমা আলীর বক্তব্যে এই তথ্য উঠ আসে। ‘আমরা একটা কেসও কিন্তু এখন পর্যন্ত জাজমেন্ট সে রকম দেখি নাই যে, গৃহশ্রমিককে মারার কারণে শাস্তি হয়েছে। গৃহকর্মীরা সবাই হতদরিদ্র আর দোষীরা সবাই প্রভাবশালী।’ আইন যদি কোন সমাধান দিতে না পারে তাহলে কি অপরাধের মাত্রা দিনে দিনে বাড়তে থাকবে? না কি এর কোন সুষ্ঠু প্রতিকার কিংবা যথার্থ সমাধান বের করা সম্ভব হবে! এখানেও সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর সেই অমিত বাণী স্মরণ করা জরুরীÑ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তা দিয়েই শত্রুর মোকাবিলা কর।’ সুতরাং সংসার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি দায়বদ্ধ নাগরিকের মাধ্যমে এই নৃশংস, অমানবিক অনাচারের প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।
শীর্ষ সংবাদ: