ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্তে জোরালো নজরদারি

সাঁড়াশি অভিযানে জাল মুদ্রার প্রবাহ কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৬ মে ২০১৭

সাঁড়াশি অভিযানে জাল মুদ্রার প্রবাহ কমেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জালমুদ্রা পাচার ও চোরাচালান সংক্রান্ত চুক্তির পর থেকে দুই দেশেই কম্বিং অপারেশন চলছে। বিশেষ করে পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর আরও সতর্কতা অবলম্বন, সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের জোরালো নজরদারি, বিমানবন্দরে বাড়তি সতর্কতা, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে জালমুদ্রার প্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। জঙ্গীরাই সবচেয়ে বেশি জালমুদ্রা তৈরি করে থাকে। বাংলাদেশ ও ভারতে জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকায় জালমুদ্রার আগ্রাসন কমে গেছে। তৈরিকারক জঙ্গীরা আত্মগোপনে চলে গেছে। অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। বাংলাদেশকে জালমুদ্রা পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে না জালমুদ্রার প্রধান হোতা হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানীরা। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরমধ্যে ১৪ নম্বর চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। ওই চুক্তি হওয়ার পর থেকেই দুই দেশেই জালমুদ্রার কারবারীদের ধরতে কম্বিং অপারেশন চলছে। এ সংক্রান্ত তথ্য দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত আদান-প্রদান হচ্ছে। ভারতের দেয়া তথ্য মোতাবেক দেশে অন্তত ১৫টি অভিযান হয়েছে। আবার বাংলাদেশের দেয়া তথ্য মোতাবেকও বহু অভিযান ভারতে পরিচালনা করেছে সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছরে অন্তত সাড়ে ৫শ’ দেশী-বিদেশী জালমুদ্রা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত সাড়ে ৪শ’ বিদেশী। এদের অধিকাংশই আফ্রিকান। উদ্ধার হয়েছে দেশী-বিদেশী বিপুল অঙ্কের জালমুদ্রা এবং জালমুদ্রা তৈরির সরঞ্জাম। জালমুদ্রার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। জালমুদ্রা কারবারীদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে জানিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী ১৮শ’ জালমুদ্রা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৭ কোটি জালটাকা ও সমপরিমাণ জালটাকা ছাপানোর সরঞ্জাম, ৫ কোটি জাল ভারতীয় রুপী, ৪ লাখ জাল ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের জালমুদ্রা। জালমুদ্রা আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের বিধান রয়েছে। দোষীদের সবোর্চ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত থাকলে জালমুদ্রার প্রভাব দিন দিন কমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ থেকে এ পর্যন্ত জালনোট সংক্রান্ত সাড়ে ৫ হাজার মামলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ৯টি শাখার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে ইতোপূর্বে জালনোটের গোপন লেনদেন ধরাও পড়েছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ৪ উর্ধতন কর্মকর্তাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভংকর সাহা জানান, জালমুদ্রার কারবার ঠেকাতে নিয়মিত মনিটরিং চলছে। প্রতিটি ব্যাংকে এ সংক্রান্ত নোটিস জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে জালমুদ্রা বিশেষ করে জালটাকা চেনার উপায় সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। মুদ্রা লেনদেনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জালমুদ্রা শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন ছাড়াও নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি যৌথ টাস্কফোর্স রয়েছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির পর দুই দেশের নানা তৎপরতার কারণে এখন মাসে ১০/১২ জালমুদ্রার কারবারিও গ্রেফতার হয় না। অথচ আগে মাসে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন গ্রেফতার হতো। চুক্তির পর থেকে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে ভারতের সঙ্গে। বৈঠকে পাকিস্তানের জালমুদ্রা কারবারিরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ ও ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, দুই দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল করে দেয়া এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটনানোর লক্ষ্যে জালমুদ্রা পাচার করে থাকে বলে আলোচিত হয়েছে। এর সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র আছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সর্বশেষ বাংলাদেশে পাকিস্তানী কূটনৈতিক ফারিনা আরশাদ ও মাযহার খানকে জালমুদ্রা ও জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধিতে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রত্যাহার করার পর বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়। সিআইডি বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতে উদ্ধার হওয়া জালমুদ্রার অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে আসা। পাকিস্তানের তৈরি জালমুদ্রা বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশ করানো হতো। ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করার পর বাংলাদেশে জালমুদ্রার প্রচলন অস্বাভাবিক হারে কমতে শুরু করেছে। জালমুদ্রার চক্রগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। জঙ্গী অর্থায়ন ও চোরাচালানে জালমুদ্রা ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভারতীয় জাল রুপী তৈরি হয়ে তা বাংলাদেশের যশোর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, শেরপুর ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করানো হতো বলে অভিযোগ ছিল। এখন সে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানা স্থাপনের অর্থের একটি বড় যোগান এসেছিল জালমুদ্রা থেকে। জালমুদ্রা জেএমবির অর্থের অন্যতম উৎস বলে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) এবং দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে। ভারতীয় মুজাহিদীনদেরও অর্থের অন্যতম উৎস জালরুপী। এসব জালমুদ্রা সীমান্তপথে আদান-প্রদান হয়। এজন্য চোরাচালানপ্রবণ স্থলসীমান্তে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেসব সীমান্ত পয়েন্টে জালমুদ্রা পাচার হয় সেসব সীমান্ত ভারত সরকারের তরফ থেকে যে সময়ে চোরাচালান হয়, সেই সময়ে সিল করে দেয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
×