ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনী হাওয়া ॥ দু’সপ্তাহের মধ্যেই ইসির রোডম্যাপ চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ মে ২০১৭

নির্বাচনী হাওয়া ॥ দু’সপ্তাহের মধ্যেই ইসির রোডম্যাপ চূড়ান্ত

শাহীন রহমান ॥ আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশে ইতিবাচক রাজনীতির হাওয়া বইছে। রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রেও রয়েছে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন চলছে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্ততি, অপরদিকে নির্বাচন কমিশন থেকেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনের খসড়া রোডম্যাপ চূড়ান্ত করেছে। এতে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এজন্য আইনের সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তভাবনা করা হচ্ছে। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করাই হবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেয়া হবে ইসির পক্ষ থেকে। এদিকে ইসির জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরির পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও গুরুত্ব পাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক কর্মকা-ের মূলে রয়েছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে অংশ নিতে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। গত নির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপিতেও এ বিষয়ে ইতিবাচক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী বাছাইয়ের, দলের ইশতেহার তৈরির কাজ পুরোদমে চলছে। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী একাদশ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে ইসির পক্ষ থেকে সে পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের ওপর প্রাধান্য দেবেন। সংলাপের যে বিষযটিতে রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তা বাদ দেয়ার কথা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির আপত্তির মুখে তারা ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরে এসেছে। খসড়া রোডম্যাপে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি রাখা হয়নি। সিইসি কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, রাজনৈতিক দল না চাইলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। এছাড়া আইনে যেখানে অস্পষ্টতা রয়েছে তাও সংলাপের মাধ্যমে দূর করার ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানা গেছে। এমনকি যেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা সঙ্কট ও দূরত্ব সৃষ্টি করে তাও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দূর করার চিন্তাভাবনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। তবে নির্বাচনমুখী এ রাজনৈতিক তৎপরতাকে অনেকে আগাম নির্বাচনের সঙ্কেত হিসেবে উল্লেখ করলেও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশে আগাম নির্বাচনের কোন সম্ভাবনা নেই। সিইসিও আগাম নির্বাচনের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, আইন অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করতে ইসির হাতে ৯০ দিন সময় থাকবে। এক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে কোন সমস্যা হবে না। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের খসড়া রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। রোডম্যাপে আগামী নির্বাচনের আগে করণীয় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত হয়ে যাবে। এরপর রোডম্যাপ অনুযায়ী তারা নির্বাচনের পথে অগ্রসর হবেন। ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি সময়সীমার মধ্যে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন তারা। ইসি জানিয়েছে, রোডম্যাপের অন্যতম প্রধান এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়েছে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ইসির এ সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছে। এতে অংশ নেয়ার আগ্রহও ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতি আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য বিএনপি মহাসচিবের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি হস্তান্তর শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি ইসির সঙ্গে সংলাপে বসতে আগ্রহী। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন, জুলাই থেকে তারা রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবেন। নবেম্বর পর্যন্ত সংলাপ চলবে। মূলত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই রাজনৈতিক দলের কর্মকা- আবর্তিত হচ্ছে সামনের নির্বাচনকে ঘিরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করার পর থেকেই সব দল এখন নির্বাচনমুখী। গত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা জোরেশোরেই উচ্চারণ করছেন। এক্ষেত্রে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছেন। যদিও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বিএনপির পক্ষ থেকে এখনও বলা হচ্ছে। তবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে বিএনপি অনেক আগে থেকেই ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছে। এমনকি দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগামী নির্বাচনে কোন দলকে একা খেলতে দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে দলটির পক্ষ থেকে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকের মতে, বিএনপির এ ভিশন মূলত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা। স্বয়ং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভিশন ২০৩০ ঘোষণায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বেশ চাঙ্গা। জানা গেছে, ভিশন ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএনপি তৃণমূলে নির্বাচনের বার্তা পাঠিয়েছে। এছাড়াও নির্বাচনে ৩শ’ আসনের বিপরীতে ৯শ’ প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি বিএনপির এ ভিশন ঘোষণাকে সরকারী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম একে বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জানা গেছে, বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল বিএনপি করেছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তারা। দলের মধ্যে আলোচনা রয়েছে, দশম সংসদে অংশ না নেয়ার কারণে রাজনীতির মাঠে তারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। দলের নেতাকর্মীদের অভিমত, দশম সংসদে অংশ নিয়ে যদি তারা বিরোধী দলেও থাকতেন তাহলেও বর্তমানে দমন-পীড়নের শিকার হতেন না। মূলত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণেই আজ রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে পারছেন না। দলীয় প্রধানসহ সারাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলার খড়গ ঘুরছে। আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা সে ভুল শোধরাতে চান। জানা গেছে, প্রয়োজনে তারা বিরোধী দলে গেলেও নির্বাচনে অংশ নেবেন। এছাড়াও জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। কারণ, আরপিও বা গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরপর দুবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে ওই দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। নিবন্ধন বাঁচাতে বিএনপির আগামী নির্বাচনে অংশ নিতেই হচ্ছে। জানা গেছে, ঝুঁকি এড়াতেই এখন পুরোপুরি নির্বাচনের দিকে মনোযোগ রয়েছে দলটির। শুধু বিএনপি নয়, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও চলছে। গত ২০ মে দলের বিশেষ বর্ধিত সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা মাঠপর্যায়ের নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্বাচনে জনগণের সমর্থন আদায়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- বেশি বেশি প্রচারের আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়াও জানা গেছে, বিশেষ সভা থেকে দলের মধ্যে বিভেদ ভুলে নির্বাচনে নেতাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও ইতোমধ্যে দলের মধ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু হয়েছে। জনপ্রিয় এবং ক্লিন ইমেজের নেতাদেরই আগামী নির্বাচনে মনোনয়নে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দলের চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ দলের নেতাকর্মীদের আগামী ঈদ-উল-ফিতরের পর ইশতেহার প্রস্তুত ও জোটের শরিকদের প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশনা দিয়েছেন। ঈদের পর দলের ইশতেহার ঘোষণা করা হবে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন রয়েছে ৪০টি রাজনৈতিক দলের। এর মধ্যে জামায়াতের নিবন্ধন আদালতের আদেশে অবৈধ ঘোষণা করায় দলটি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তাছাড়া তাদের দলের প্রতীকটি ইতোমধ্যে আদালতের অনুরোধের কারণে বাদ দেয়া হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বেশি। এ তিনটি দলের পাশাপাশি নিবন্ধিত অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে নির্বাচনমুখী মনোভাব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণে একমত হলে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল এমনিতেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে ইসির রোডম্যাপে সাতটি সুনির্দিষ্ট করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কাজগুলো কখন কিভাবে সম্পন্ন করা হবে তার সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়েছে এতে। ইসি বলছে, নির্বাচন অবৈধ অর্থ ও পেশীশক্তির ব্যবহারমুক্ত রেখে সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির লক্ষ্যে রোডম্যাপ তৈরি করে সে অনুযায়ী পথ চলবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী চলতি বছরের মধ্য জুলাই থেকে নবেম্বর পর্যন্ত তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করতে চায়। এছাড়াও আইনী কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কারের মতো গুরত্বপূর্ণ কাজ নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন করতে চায় তারা। ডিসেম্বর মাসে খসড়া আইনগুলো প্রণয়ন করবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ নেয়ার চিন্তভাবনা রয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই সব আইন চূড়ান্ত করবে। এছাড়াও ইসির কর্মপরিকল্পনায় সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও নতুন দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিবন্ধন দেয়া এবং নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজটি তারা নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন করতে চায়। এরপর তারা একাদশ জাতীয় নির্বাচনের চূড়ান্ত কাজ শুরু করবে।
×