ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

বেসরকারী খাতের চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ ॥ অতএব সবাই সাবধান

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ২৬ মে ২০১৭

বেসরকারী খাতের চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ ॥ অতএব সবাই সাবধান

সারাদেশে দাবদাহ চলছে। ঢাকা শহরও এর থেকে মুক্ত নয়। রোদে টেকা যায় না। বয়স্করা ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। শিশুদের স্কুল করাও কঠিন হয়ে উঠেছে। লোকে বলছে এমন গরম নাকি তারা আর ভোগ করেনি। এরই মধ্যে যথারীতি বেশ পরিমাণ লোডশেডিং হচ্ছে, যদিও তা সহ্যসীমার বাইরে নয়। রাস্তায় রাস্তায় পাকা আম। সহজেই আম আবার গরমে পচেও যাচ্ছে। রাজশাহীতে গাছে আম পাকছে অকালে, নিতান্তই গরমে। কী গ্রাম, কী শহর সর্বত্রই একই অবস্থা। এক বন্ধু কলকাতা থেকে বলল তারা গরমে মারা যাচ্ছে। প্রচ- গরম। বৃষ্টির কোন আভাস নেই। আবার অনেকে বলছেন এটা জ্যৈষ্ঠ মাস। বোরো ফসল এখনও তোলা শেষ হয়নি। যাদের ফসল দেরিতে লাগানো হয়েছে তাদের জন্য ভাল। ধানটা ঘরে উঠে যাবে। যা হাওড় অঞ্চলে এবার হয়নি। অসময়ে জলের তোড় ৫টি জেলার কৃষকদের একদম পথে বসিয়ে দিয়েছে। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি জেলার কৃষকদের গরমে ক্ষতি হয়নি। তাদের ক্ষতি হয়েছে অকাল বন্যার জলে। ফসল গেছে, সবজি গেছে, মাছ গেছে, গেছে পশুপাখি। বস্তুত বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি অঞ্চলের লোকেরা এখন সরকারী সাহায্যে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাঁচা কী এত সহজ? না, এত সহজ নয়। উদাহরণ দিই একটি। শান্তিনগর অঞ্চলের ঘটনা, সেদিনকার। প্রচ- রোদে দাঁড়িয়ে আছি। রিক্সা আছে, কিন্তু কেউ যাবে না, তারা বিশ্রামরত। চারদিকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। কারণ রাস্তা নানা জায়গায় ভাঙ্গা। এমতাবস্থায় প্রমাদ গুনছি। কী করা যায়? অথচ আমাকে যেতেই হবে। নাতিকে স্কুল থেকে আনতে হবে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না তখন এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা আমার সামনে এসে হাজির। সাক্ষাত দেবতা আর কী। কোন প্রশ্ন না করেই উঠে পড়লাম তার রিক্সায়। উঠে পড়ে নানা জেরা শুরু করি তাকে। যা জানলাম তাই পাঠকদের বলছি। এই বৃদ্ধের বয়স ৬০-এর ওপরে। নাম আলি মিঞা। সে বিপদে পড়ে রিক্সা নিয়ে নেমেছে। যদিও এই স্বাস্থ্যে রিক্সা চালানো উচিত নয়। কিন্তু খাবার নেই ঘরে। অনেক কারণ। প্রথমত এরা তিন রিক্সাওয়ালা মিলে এক লাখ টাকায় ধান কিনেছিল কিশোরগঞ্জের হাওড়ে। এটা ‘দাদন’ ব্যবস্থা। কম টাকায় কৃষকের কাছ থেকে ফসল ওঠার আগেই ধান কিনে নেয়ার রীতি ওই অঞ্চলের একটা প্রাচীন রীতি। ‘দাদন’ দেয়ার সময় তাদের ধারণা ছিল ওতে তাদের বেশ লাভ হবে। ওই লোভে তিনজনে মিলে এই ‘কারবার’। কিন্তু পাহাড়ী জল এবং অতিবৃষ্টিতে সেই দাদনের ফসল ভেস্তে গেছে। আলি মিঞা ভেবেছিল দাদনের ধান বিক্রি করে বছরের খাবারের চাল জোগাড় করবে, সেটা হয়নি। সবচেয়ে বড় আঘাত অন্যত্র। তার এক ছেলে চাকরি করত একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। পিয়নের চাকরি। কোনমতে ‘এসএসসি’ পর্যন্ত তাকে পড়িয়েছিল। এরপর পড়া আর হয়নি। সৌদি আরব পাঠানোর জন্য বেশ টাকা খরচ করেও সেই যাওয়া আর হয়নি। টাকা গেছে মার। এসবই রিক্সা চালনা থেকে আয়। ওপরওয়ালার সেই ‘সুখ’ সয়নি। ছেলেটির চাকরিটা চলে গেছে। অথচ ‘সৌদি’ যাওয়াও হয়নি। ছেলেকে করিয়েছিল বিয়ে। বউটি থাকে গ্রামে। ঢাকায় আনা হয়নি এখন। এই মুহূর্তে তার বিপদ চারদিকে। ধান গেছে, ছেলের চাকরি গেছে, বউকে এখনও ঘরে তোলা হয়নি। সবদিকে অন্ধকার। বাঁচার কোন পথ নেই ভেবে এই প্রখর রোদেই রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছে আলি মিঞা। ছেলে ‘ম্যাট্রিক’ পাস। রিক্সা চালাতে চায় না। তার সঞ্চয়ও বেশি নেই যে, কোন একটা ‘হকারি’ জাতীয় ব্যবসা ধরবে। অথচ ঘরে চাল বাড়ন্ত। এসব দুঃখের কথা শুনতে শুনতেই সেদিন বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছলাম। বলার কিছুই নেই। এসব দুঃখের কোন শেষ নেই। ফসল গেলে এর কোন প্রতিকার নেই। দেশের ফসল বীমা এখনও চালু হয়নি। বোধ হয় প্রকল্প হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এদিকে চাকরি গেলে কী হবে? বেকার ভাতা দেশে নেই। মালিকরা আজকাল হরেদরে লোকজন বিদায় করে দিচ্ছে। কোন ক্ষতিপূরণ দেয়ার রীতি দেশে গড়ে ওঠেনি। অথচ এমন এক সময় ছিল যখন বেসরকারী খাতের চাকরিও ছিল সরকারী চাকরির মতো। চাকরি যেত না। মালিকরা তাদের কর্মচারী-গোমস্তাদের আজীবন পালত। বিদায় করে দিত না। আনুগত্যের বড় দাম ছিল। দক্ষতার দাম যে ছিল না তা নয়। কিন্তু আনুগত্যের মূল্য ছিল অনেক বেশি, যা জাপানের শিক্ষা, এমনকি ভারতীয় বড় বড় মালিকদের ব্যবসার শিক্ষা। ভারতে এখনও এমন বড় বড় মালিক আছেন যারা কর্মচারীদের হরেদরে যখন-তখন বিদায় করেন না। অনেক গুজরাটি, পার্সি, জৈন ব্যবসায়ী আছেন যারা তাদের মেয়ে-ছেলের বিয়ে উপলক্ষে কর্মচারীদের সোনা-দানা উপহার দেন। বোনাস হিসেবে দেন গাড়ি। আমাদের বাংলাদেশেও তা ছিল। নাম বলছি না, এমন ব্যবসায়ী ছিলেন যারা কর্মচারী অক্ষম হয়ে গেলেও তাদের প্রথমদিকে বাড়িতে বেতন পাঠিয়ে দিতেন। গ্রাম-গঞ্জের মহাজনরা তাদের কর্মচারীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, ছেলেমেয়েদের বেতন, বইপত্র পর্যন্ত কিনে দিতেন। এটা ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ব্যবসার সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই বিষয় মহাজনরা কোনদিন বইয়ে পড়েননি। কিন্তু তারা এই কাজটি করতেন সংস্কৃতি পালনের অংশ হিসেবে। অথচ আজ? দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় পাকিস্তান আমলের বড় বড় মালিক, বাংলাদেশের প্রথম দিককার মালিকদের বংশধর ব্যবসায়ীরা এখন সকালে মানুষের চাকরি খায়। বিকেলে খায়। হায়ার এ্যান্ড ফায়ার তাদের নীতি। তারা এসব নাকি বিদেশ থেকে শিখছে। কী বিদেশী কোম্পানি, কী দেশী কোম্পানি সবাই আজ বিনা বিচারে লোকের চাকরি খাচ্ছে। বিপরীতে সরকারী চাকরি হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লোভনীয়। ওই চাকরি কখনও যায় না। এখন তো বেতন-ভাতা বেশ ভাল। তাদের দায়-দাবি সরকার যখন-তখন পূরণ করে দিচ্ছে। এ কারণে সরকারী একটা সামান্যতম চাকরির জন্যও গ্রামের লোকেরা পাঁচ-সাত-দশ লাখ টাকা খরচ করতে রাজি। চাকরির জন্য যে কোন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হরেদরে ফাঁস হচ্ছে। সবাই বুঝে নিয়েছে বেসরকারী খাত নয়, চাকরি করলে করতে হবে সরকারের চাকরি। এই চাকরি যাবে না কখনও। কাজ করলে ওভারটাইম, না করলে বেতন। সরকারী জায়গা কম দামে পাওয়া যায়। তাদের আমৃত্যু পেনশন, ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত। তাদের সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি। তাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ বেশি। বিপরীতে বেসরকারী খাতে এক সময় ভাল বেতন ছিল। তা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। সবচেয়ে সংগঠিত বেসরকারী ব্যাংকিং খাতে প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কাজে অসন্তুষ্ট। এই তথ্য আমার নয়। ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)’-এর এক জরিপ এ কথা বলছে। এই খাতে প্রধান নির্বাহীর বেতন বাড়ে, অন্যদের বাড়ে না। শাখায় শাখায় কাজের লোকের অভাব, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পদোন্নতির সুযোগ সীমিত। চাকরি যাচ্ছে হরেদরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্যে দেখা যায় ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ‘নিট প্রফিট’ বেড়েছে ১৯০২ গুণ। বিপরীতে মোট কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৫ গুণ। বিষয়টি বোঝা গেল? এই ব্যাংকিং খাত শুধু মুনাফার দিকেই দৃষ্টি দিচ্ছে। একজন কর্মী দিয়ে তিনজনের কাজ করানো এদের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এর বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রতিবাদ করতে পারে না। শত হোক ‘ক্যাপিটেলের’ বিরুদ্ধে ‘লেবার’ কী করবে? সরকার তো ‘ক্যাপিটেলের’ পক্ষে। এটা না হলে অন্তত বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়টা দেখতে পারত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেখানকার অবস্থা আরও খারাপ। ১৯৯৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ বেড়েছে অনেক। অথচ কর্মীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ছিল ৬,৪৩৫, আর আছে এখন ৫,৭২৬। একজনকে দিয়ে তিনজনের কাজ করানোর এই নীতি আমার ধারণা শ্রম অধিকারবিরোধী। বিষয়টি একটা বড় ধরনের গবেষণার মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে আনা দরকার। কী কারণে ব্যাংকিং খাতে নতুন চাকরির সুযোগ বেশি বেশি সৃষ্টি হচ্ছে না, কী কারণে লোকের চাকরি যাচ্ছে, কী কারণে তাদের প্রকৃত মজুরি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে তার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। এটা সরকারের দায়িত্ব। বাজার অর্থনীতির কথা বলে পুঁজির মালিকদের এই অবিচার সহ্য করার বিষয় হতে পারে না। শুধু বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলো নয়, বিদেশী কোম্পানিগুলোও অবিচারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। কর্মী ও কর্মচারীদের চাকরি যখন-তখন যাচ্ছে। কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম অসন্তোষ। অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে কম মজুরি, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি। সরকার অতিরিক্ত সুরক্ষা দেয়ার কারণে বিদেশী কোম্পানিগুলো শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। অথচ এরা আমাদের দেশীয় কোম্পানির শ্রমিক অধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলে। একটি কাগজে দেখলাম শেভরন, হোলসিম, গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক নামীয় কোম্পানগিুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ চরমে। কেউ সেখানে কোন কথা বলতে পারে না। আরেক বিপদ হয়েছে কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন। এর মানেই হচ্ছে লোকে চাকরি পাবে। তারা সুযোগ-সুবিধা কিছুই পাবে না। প্রশ্ন, এসব ক্ষেত্রে কী সরকারের মহামান্য মন্ত্রীদের কোন দায়িত্ব নেই? সংশ্লিষ্ট বিভাগের কী কোন দায়-দায়িত্ব নেই? মূল প্রশ্ন চাকরিচ্যুতি। দেশে এমনিতেই নতুন নতুন কর্মসংস্থান, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। অন্তত হচ্ছে না প্রয়োজন অনুপাতে। সেখানে যদি লোকজন মধ্য বয়সে রাস্তায় পড়ে তাহলে এর পরিণতি কী? সবাই কী ব্যবসা করে খাবে? সবাই কী ‘স্টার্ট আপের’ মালিক হবে? যাদের পক্ষে সম্ভব তারা তা করছে। কিন্তু সবাই তো ব্যবসা করে খেতে পারবে না। সবাই তো সরকারী চাকরিও পাবে না। তাহলে উপায় কী? ঠিক আছে ‘বেকার ভাতা’র ব্যবস্থা করুন। বিনা কারণে যাতে লোকের চাকরি না যায় তা দেখার জন্য একটা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হোক। চাকরি যেতে হলে যাতে যথাযথ পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় তার ব্যবস্থা করা হোক। প্রশ্ন বাজার অর্থনীতিতে কী এসব সরকারের দায়িত্ব? ট্রাম্প এসব ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ। বাজার অর্থনীতির ফলে আমেরিকান আইটি কর্মীরা কাজ পেত না। অল্প বেতনে কাজ নিয়ে যেত ভারতীয় ও অন্যরা। তিনি তাতে হস্তক্ষেপ করেন। অল্প দামে ভারতীয় কর্মী নিয়োগ দেয়া যাবে না। বাজার অর্থনীতির ‘ঠাকুরদা’ যদি এটা করতে পারে তাহলে আমরা কে? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×