ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুন্ডু

বিচারে ১২ অ্যাংরিমেন

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২৫ মে ২০১৭

বিচারে ১২ অ্যাংরিমেন

আইনের পক্ষে বেআইনী কাজকে সমর্থন দেয়া চলে না। বাবা বুশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাবস্থায়ও কন্যাকে জরিমানা দিতে হয়েছিল। কারণ আমেরিকান নিয়মে সুরাপানের দিক দিয়ে সে ছিল অপ্রাপ্ত বয়স্ক। ইংল্যান্ডের রানীর গাড়িকেও একবার জরিমানা দিতে হলো ঠিকমতো গাড়ি পার্কিং না করার জন্য। আইন নিরপেক্ষ এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রযোজ্যের স্বার্থেই বিচারকি কার্য হতে হয় প্রমাণ সাপেক্ষে, বাদী-বিবাদী উভয়ের সমান অংশীদারিত্বপূর্ণ এবং বিচারকের মননশীল বিবেচনা প্রসূত। ফলে বার জন জুরি সদস্যের এগার জন উনিশ বছর বয়সী পুত্রকে পিতার খুুনী হিসেবে মেনে নিলেও একজন মাত্র জুরি সদস্যের বিরোধিতাকে বিবেচনায় নিয়ে, বিচারক চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে জুরিদের পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান। একটা খুুন, একটা প্রায় সুনিশ্চিত খুনী হিসেবে ঘোষিত ব্যক্তির দোষী কিংবা নির্দোষিতা নিয়ে এগার জন জুরির প্রতিপক্ষ একজন জুরির মরমীয় লড়াইয়ের নাটক ১২ অ্যাংরিমেন। রেজিনাল্ড রোজ রচিত ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য অবলম্বনে, অসীম চট্টোপাধ্যায়ের সাবলীল অনুদিত, মাত্রা নিয়ন্ত্রিত এবং বলিষ্ঠ নিদের্শক এম আরিফুর রহমান, ওপেন স্পেস থিয়েটার প্রযোজিত নাটক ১২ অ্যাংরিমেন-এর উদ্ধোধনী মঞ্চায়ন হলো গত ১৮ মে শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল হলে। এক্সপেরিমেন্টাল হলে এসির বাতাস কিংবা হ্যালোজেনের বর্ণিল আলোয় উনিশ বছর বয়সী ছেলেটির বেড়ে ওঠা না। বেড়ে ওঠা অস্বাস্থ্যকর, আলো-বাতাসহীন বস্তি পরিবেশে। নিত্যকলহ, পদে পদে মানবতার অপমান এবং একমাত্র আশ্রয় পিতার হাতে নিত্য প্রহার তার প্রত্যাহিক প্রাপ্য। ফলে বিগত সময়ে চাকু চালিয়ে শোধনাগার থেকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামি হিসেবে ফিরতে পারলেও এবার চাকু চালিয়ে পিতাকে খুন করার সন্দেহে সম্ভাব্য ফাঁসির রায়ের মুখোমুখি। অপরাধ সংঘটিত স্থান দোতালায়। অপরাধ সংঘটিত হতে সরাসরি দেখেছে রাস্তার অপরপ্রান্ত থেকে এক নারী এবং চিৎকার করে খুন করবার ঘোষণা শুনেছে নিচতলার বৃদ্ধ। উপরন্ত ছেলেটি চাকু চালাতে দক্ষ বিধায় এ খুন করা তার পক্ষে মামুুলি এ বিষয়ে এগারজন জুরি নিশ্চিত। কিন্তু আসামির প্রতি সহৃদয় আট নম্বরের জুরি। অপর পাশ থেকে কামরার ভেতর চোখ গলিয়ে নারীর পক্ষে চাক্ষুস সংগঠিত খুন দেখা অসম্ভব কেননা তিনি চশমা ছাড়া দূরের কোন জিনিস দেখেন না এবং প্রাকঘুমের মুহূর্তে তার চোখে চশমা না থাকবারই কথা। দ্বিতীয়ত, চালন্ত ট্রেনের শব্দের মুহূর্তে নিচ তলায় বসে ওপরের তলার শব্দ শোনা অসম্ভব। তৃতীয়ত, ছেলেটির মত দক্ষ চাকু খেলোয়াড় এমন এ্যামেচারভাবে চাকু চালাবে না। জুরি আটের যৌতিক সংলাপ পরম্পরায় এবং কার্য কারণের ব্যাখ্যায় একে একে অবশিষ্ট এগার জুরি সহমত প্রকাশ করে যে ছেলেটি নির্দোষ, সে তার বাবাকে হত্যা করেনি আর সেখানেই শেষ হয় ১২ রাগী মানুষের রাগ-অনুরাগ মোচনের মধ্যে দিয়ে দেখাকে ঠিকমতো দেখবার নাটক ১২ এ্যাংরিমেন। অসীম চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ যেমন সরল তেমনী প্রাসঙ্গিক বাঙালী কারণ। শুধু বাঙালীকরণ না বরং বার জুরি আর একজন মহুরি মোট তেরো চরিত্রের বিশ্বায়নে তের অভিনেতার পুঙ্খানুপুঙ্খ আত্মিক বাহ্যিক মেলবন্ধন রচনার নির্দেশক এম আরিফুর রহমান যেন মঞ্চ নাটকের নির্দেশনায় এ্যাক্টর পেইন্টার। যেমন সঞ্চলক (কাজী আরিফুর রহমান) চরিত্রের নিরপেক্ষতা কিন্তু সবাইকে নিয়ে চলা, এলিট সোসাইটির উন্নাসিকতা (শরিফুল এম তারিফ), যৌতিকভাবে গোড়ামিত্ব (মুসাব্বির তানিম) কিংবা একক লড়াইয়ে অচল থাকা (এম আরিফুর রহমান) অথবা প্রাঞ্জতায় নির্মহ (এজাজ আহমেদ) সিদ্ধান্তে আসা প্রভূতি একে অপরকে ছাড়িয়ে। বোধে আঘাত দিয়ে বোধদয় ঘটান (প্রসঙ্গ নিশ্চয়ই আপনি বলছেন অর্থ আপনি আমায় খুন করেননি কিংবা দুটো চাকুর সাদৃশ্য করণ প্রভৃতি বিবেচ্য) দৃশ্য আবহে দ্বান্দ্বিকতা এনে মনকে জাগানো আবার আলো কমিয়ে চোখের বিশ্রাম আনন্দের। নিরুপায় না হলে মানুষের পোশাকই যে তার মনের প্রকাশ সেটি এই নাটকের নাটকীয় চরিত্রদের ক্ষেত্রে প্রকাশিত। নির্দেশক অভিনেতা হিসেবে প্রকাশিত ও বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে দল প্রধান, পোশাক-মঞ্চ ব্যবস্থাপনা মাহ্জাবীন চৌধুরী তিশা। নির্দেশক এম আরিফুর রহমানের যোগ্যশিল্প সঙ্গী ও সহমর্মী তা প্রযোজনা চলার প্রথম আগমন থেকে সমাপ্তিতে নাট্য ব্যক্তিদের আন্তরিক আহ্বানে স্পষ্ট প্রতীয়মান। যেহেতু এই প্রযোজনায় সংশ্লিষ্ট নাট্যকর্মীদের অনেকে একাডেমিশিয়ান তাই তাদের বৃহত্তর যাত্রা পথকে সামনে রেখে শুধু বলবার, যেটি মঞ্চায়িত হলো তার অতিরিক্ত কিছু না করা (অতি সন্ন্যাসীতে আসরের গাজন নষ্ট বিবেচ্য), আমরাই কেউকেটা এই অহংবোধকে প্রশ্রয় না দেয়া এবং নাটক শেষে পারফর্মের বক্তব্য অনিবার্যভাবে না বলা। এটুকু বলা এ কারণে, এত সুন্দর স্ত্রিপ্ট এবং অভিনয় অনেক দিনের অবসানে পাওয়া গেল। জমার আগে খরচা করে ওপেন স্পেস থিয়েটার পথে নামুক এ দেখতে মন চায় না। মানব মনকে পরিশুদ্ধ করে ১২ অ্যাংরিমেন এর মূল্য বোধের মঞ্চায়ন।
×