ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নীলফামারীতে বাণিজ্যিক চাষ

চায়ের পাশাপাশি কফি বদলে যেতে পারে উত্তরের অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৫ মে ২০১৭

চায়ের পাশাপাশি কফি বদলে যেতে পারে উত্তরের অর্থনীতি

তাহমিন হক ববী ॥ কফির কথা মনে হলেই প্রথমেই মান্না দে’র গাওয়া জনপ্রিয় ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি মনে পড়ে যায়। কিন্তু ‘কফির’ এই আড্ডাটা উত্তরবঙ্গের নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও জেলায় চা পাতার মতো বাণিজ্যিকভাবে যে জমতে পারে এমন সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। অথচ আমাদের দেশের কফির প্রয়োজনীয় চাহিদার সবটুকুই আমদানি নির্ভর। চায়ের তুলনায় দাম একটু বেশি বলে বাংলাদেশে এই কফির চাহিদা কম নয়। দেশের উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলা সদর ইউনিয়নের মুন্সিপাড়া গ্রামের কফি চাষী ৭৩ বছরের বৃদ্ধ আব্দুস কুদ্দুস এখন বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ করছেন। তিনি সফলতা নিয়ে এসে দুই হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে কফি বিক্রি করছেন। শুধু কফি চাষ নয়, তিনি কফির চারাও বিক্রি করছেন। ইতোমধ্যে তার কফি চাষের কথা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অনেকে কফি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করে চারা সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। আব্দুস কুদ্দুস নিজ উদ্যোগে গত তিন বছর ধরে কফি চাষ করলেও বাজার ব্যবস্থাপনা, কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাব এবং কৃষি বিভাগ বা চা বোর্ডের পক্ষে কোন সহযোগিতা না পেলেও একমাত্র নিজের মনের শক্তিতে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষের পথে এগিয়ে চলছেন তিনি। স্বপ্ন নয় রীতিমতো সফলতা পাচ্ছেন তিনি। নার্সারি ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস কফির বাণিজ্যিক চাষে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এ অঞ্চলের সবাইকে। তবে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, রংপুর ও দিনাজপুর কৃষি অঞ্চলের আট জেলায় ১০ হাজার হেক্টরে ৩০ লাখ কফির গাছ রোপণ করা গেলে প্রতি বছর বছর সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার কফি উৎপাদন সম্ভব, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চল এবং বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব। মরহুম জোনাব আলীর ছেলে এই কফি চাষী ও বিস্মিল্লাহ নার্সারির মালিক আবদুস কুদ্দুস জানান, দেশের পার্বত্য এলাকায় সর্বপ্রথম কফির চাষ শুরু হয়। কক্সবাজারে এখন বিশ্বমানের কফি চাষ হচ্ছে। কক্সবাজারের জাহানারা এ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ২০১৪ সালে ১৫০টি চারা এনে মাত্র দেড় শতক জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেন। কফির গাছ বাড়তে থাকে। দুই বছর পর ফলন শুরু হয়েছে। কফির গাছগুলো আমি জাল দিয়ে ওপর থেকে ঘিরে রেখেছি। যাতে পাখিরা খেয়ে ফেলতে না পারে। শুকনো কফি আপাতত আটার মিলে মাড়াই করে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করছি। এ কফির স্বাদ ও গন্ধ দুটোই ভিন্ন। খুব সুস্বাধু ও মনকাড়া। তিনি বলেন, গত বছর আমি ৬০ কেজি কফি উৎপাদন করেছি। যা আড়াই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। এবারও ভাল ফলন হয়েছে। তিনি বলেন, বিষয়টি আমি স্থানীয় কৃষি বিভাগকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ চেয়েছি একাধিকবার। কিন্তু কৃষি বিভাগের সে রকম কোন আগ্রহ আমি দেখিনি। তিনি বলেন, আমার বাগানে উৎপাদিত কফি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে চেষ্টা করি। এ জন্য বিএসটিআইএর লাইসেন্সের জন্য রাজশাহী যাই। কিন্তু সেখানে থেকে লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ফলে কফির মূল্য আমি পাইনি। তবে আমার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু চারা কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের খানসামা এলাকার উত্তর বাঁশখানা গ্রামের অনেকেই নিয়েছেন। তারাও চাষ শুরু করছেন। আবদুস কুদ্দুসের মতে, উত্তরাঞ্চলে চা এর চাষ হচ্ছে। ব্যাপকভাবে কফি চাষ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সরকার ও কৃষি বিভাগের কার্যকরী উদ্যোগ। তাহলে কফি চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু করা সম্ভব। এতে দেশের গ-ি পেরিয়ে কফি আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা যেতে পারে। এতে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে।এখন কৃষি বিভাগ এবং কৃষকেরা এগিয়ে এলেই কফি চাষের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে রংপুর এলাকা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কফি চাষী আরও জানান, ডাঙ্গা, দোঁআশ বা বালু মাটির ভূমিতে কফি চাষের উপযোগী। আমাদের উত্তরাঞ্চল জুড়ে এমন ভূমি অনেক। এমন জমি এছাড়া রাবার বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো যায় কফির চারা। বাড়ির আঙ্গিনা, ফুলের টব কিংবা বাড়ির ছাদেও কফির চাষ সম্ভব। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় হলো কফির মওসুম। এই সময় কফির উপযোগী স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও পরিমিত উষ্ণতা বজায় থাকে। এতে গাছ অল্প সময়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, প্রচুর ফল ধরে ও ফলগুলো যথেষ্ট পুষ্ট হয়। কফি বাগান করে ফলানো হয়। গাছ স্বাভাবিকভাবে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হলেও কফি ফল সংগ্রহের জন্য বাগানের গাছ লম্বা করা হয় না। গাছের ডালপালা ছেঁটে দুই মিটারের মধ্যে রাখা হয়, যাতে গাছের ফল হাতের নাগালে থাকে। চারা রোপণের দুই বছরের মধ্যে কফির গোটা সংগ্রহ করা যায়। কফির গোটাগুলো দেখতে অনেকটা গমের মতো। তবে তা আকারে একটু বড়। একটি কফি গাছ থেকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়। খুব অল্প সময়ে কফি তৈরি করা যায়। কফির বিনগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয় কফি। এ কফি বাজারের সাধারণ কফির চেয়ে সুস্বাদু। বাজারের কফিতে কেমিক্যাল ও প্রিজারবেটিভ থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে কফি চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটি গাছে খরচ হয় এক থেকে দেড়শ’ টাকা। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে আধা কেজি বা তারও বেশি কফির গোটা বা ফল পাওয়া যায়। কৃষি উদ্যোক্তা এসএমএম ফখর উজ জামান জাহাঙ্গীর বলেন, রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে সরকারের কৃষি বিভাগ উদ্যোগ নিয়ে উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে ১০ হাজার হেক্টরে কফির গাছ লাগালে তাতে ৩০ লাখ গাছ লাগানো সম্ভব। যেখান থেকে প্রতি বছর ১৫ লাখ কেজি কফি উৎপাদন সম্ভব। যা থেকে প্রতি বছর গড়ে তিন হাজার টাকা করে কেজি বিক্রি করতে পারলে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আয় সম্ভব। যা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও আয়েরও মাধ্যম হতে পারে। তিনি আরও জানান, পরিকল্পিতভাবে এই কফি চাষ শুরু করতে পারলে পাঁচ বছরের মধ্যে ২০ হাজার হেক্টরে কফি চাষ করা সম্ভব; যা থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক স্থানীয় অর্থনীতিতে যোগ করতে পারবেন কৃষকরা। কৃষিবিদ দেওয়ান কামাল আহমেদ বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিক্রীত পণ্য এবং বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি পান করা পানীয়ের মধ্যে অন্যতম কফি। কফির উৎপত্তিস্থল ইথিওপিয়ায় পনের শত শতাব্দিতে। ইউরোপীয়দের মধ্যে ব্রাজিলে প্রথম আসে পর্তুগিজরা। বিশ্বের মোট কফি উৎপাদনের ৪০ শতাংশ আসে ব্রাজিল থেকে। যার রফতানি মূল্য প্রায় ৮০ কোটি ডলার। ২০০০ সালের দিকে বিশ্বে ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন কফি উৎপন্ন হলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন টনের ওপরে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর কফি দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে এ ফলের গাছ জন্মে। সবুজ কফি বিশ্বের সব থেকে বেশি বিক্রীত কৃষি পণ্যের মধ্যে একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে এখন কফির চাষ হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশেও কফির চাষ হচ্ছে পার্বত্য এলাকায়। তিনি মনে করেন বাংলাদেশে কফি এখন একটি সম্ভাবনাময় ফসল। কৃষি বিভাগ এবং সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিলে চা এর পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় কফি চাষ করে তা রফতানি করতে পারলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।
×