ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ নাই পরোয়া ...

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ মে ২০১৭

যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ নাই পরোয়া ...

মোরসালিন মিজান ॥ যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত, আজ নয় কা’ল ভাঙবে সে ত,/ যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া...। মানুষ এবং মানবতার পক্ষে আর কে বলতে পারে এমন করে? কার প্রতিবাদী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়Ñ ‘মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া?’ অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে বহু বহু কাল আগে সরব হওয়া কণ্ঠটি, বলার অপেক্ষা রাখে না, কাজী নজরুল ইসলামের। মাত্র দুইদিন আগে যুক্তরাজ্যে কনসার্টে বোমা মেরে মানুষ হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে- জাত পাত ধর্মের নামে খুনাখুনী এখনও অব্যাহত। সত্য সুন্দরের বোধ দাঁড়াতে পারছে না। অশান্ত সমাজ। অস্থিতিশীল পৃথিবী। বেদনার এই ক্ষণে প্রেম দ্রোহ ও সাম্যের সুমহান বাণী নিয়ে তাই সামনে এসে দাঁড়ান কবি। সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের জন্মদিন আজ। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ বৃহস্পতিবার ১১৮তম নজরুল জয়ন্তী। কবির ভাষায়Ñ আমি যুগে যুগে আসি/ আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু। পরাধীন সময়ে ঝড়ের মতো, ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল নজরুলের। সেই কবে কার কথা! অথচ এই এখনও বিস্ময়কর আলো হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ সারাদেশে উদ্যাপিত হবে নজরুল জয়ন্তী। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসছে নবীনÑ জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন! তাই সে এমন কেশে বেশে/ প্রলয় বয়েও আসছে হেসেÑ মধুর হেসে/ ভেঙে আবার গ’ড়তে জানে সে চির সুন্দর...। নজরুল চির সুন্দরের নাম। দ্রোহ এবং প্রেমের অভূতপূর্ব সম্মিলন তিনি। সাম্যের মানবের এবং মানবতার কবি হয়ে উঠে ছিলেন ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছিলেন। সারা জীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ তিনি। তিনি কবি কা-ারি কাজী নজরুল ইসলাম। নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন তিনি। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষকেও কাছে টেনে নিয়েছেন। নারীর প্রতি উপেক্ষা মেনে নেননি। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন কবি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার নজরুল তার চার সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরানের আলোকে। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম কৃষ্ণ মুহাম্মদ। বাকিদের নামকরণ করা হয়Ñ অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। কিংবদন্তি কবির জন্মÑ ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। মহকুমা আসানসোল। গ্রামের নাম চুরুলিয়া। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, পড়ালেখা শুরু করেন মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে রুটির দোকানে কাজ নেন। মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। সাহিত্য চর্চার শুরু বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি বলেনÑ ...আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/ আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/ আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র। কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাঁর সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার তাঁর। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়। তবে জীবনের বড় অংশজুড়ে ছিল টিকে থাকার সংগ্রাম। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, কাজী নজরুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালজয়ী কবি। আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’। পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, বঞ্চনা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাঁর কণ্ঠ। নজরুলের ক্ষুরধার লেখনীর স্ফুলিঙ্গ যেমন ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়েছে, তেমনি তাঁর বাণী ও সুরের অমীয় ঝর্ণাধারা সিঞ্চিত করেছে বাঙালীর হৃদয়কে। প্রধানমন্ত্রীর বাণী পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালীর কর্ম চিন্তা ও মননে কাজী নজরুল ইসলামের অবিনশ্বর উপস্থিতি। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক। অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তার স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশব্যাপী নানা আয়োজন এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে সারাদেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। আজ সকালে কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করবেন সর্বস্তরের মানুষ। এর পর দিনভর চলবে আলোচনা স্মৃতিচারণ উৎসব অনুষ্ঠান। বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ছায়ানটে এরই মাঝে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী নজরুল উৎসব। প্রথম দিন বুধবারের আয়োজনে ছিল কথন, গান, পাঠ,আবৃত্তি ও নৃত্যের পরিবেশনা। আজ বৃহস্পতিবার একই রকম আয়োজনে শ্রদ্ধা জানানো হবে বিদ্রোহী কবিকে। বাংলা একাডেমি বিকেলে কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে নজরুল বিষয়ক একক বক্তৃতার আয়োজন করবে। একক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক এমএম আকাশ। একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নজরুলগীতি পরিবেশন করবেন শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। নজরুল একাডেমি দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা হাতে নিয়েছে। বুধবার শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজনের শুরু হয়। আজ বৃহস্পতিবারও সঙ্গীতের ভাষায় শ্রদ্ধা জানানো হবে জাতীয় কবিকে। আজ নজরুল মেলার আয়োজন করবে চ্যানেল আই। মেলায় থাকবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৫টি স্টল থাকবে। উন্মুক্ত মঞ্চে থাকবে নজরুল সঙ্গীত, নৃত্যনাট্য, নজরুলের কবিতা থেকে আবৃত্তি, নজরুল রচনাবলী থেকে পাঠ, আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে নজরুল বিষয়ক ছবি আঁকার আয়োজন। মেলার স্টলে প্রদর্শিত হবে নজরুলের সৃষ্টি সম্ভার। মেলা সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই।
×