ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কালোবাজারি মুনাফাখোরদের ধরতে ক্রেতার বেশে গোয়েন্দা তল্লাশি চলছে, হচ্ছে তালিকা ;###;নজরদারিতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, নির্দেশ পেলেই ব্যবস্থা

গোয়েন্দারা মাঠে ॥ রমজানের আগেই বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৫ মে ২০১৭

গোয়েন্দারা মাঠে ॥ রমজানের আগেই বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান

শংকর কুমার দে ॥ রমজান সামনে রেখে মুনাফাখোর কালোবাজারি, মজুদদার, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটে নেয়ার বিরুদ্ধে বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিত্যপণ্যের মজুদ পরিস্থিতি ভাল। অথচ বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করছে এক শ্রেণীর অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এসব অসৎ মজুদকারীর তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। রমজানে বাজারের মূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে কালোবাজারির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। গোয়েন্দা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্রমতে, রমজান মাস সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিত্যপণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির পাঁয়তারা বন্ধে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। এ বছর সরকার রমজান মাসে বাজার মূল্য স্থির রাখতে রোজার আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেছে। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগাম তথ্য সংগ্রহে মাঠে নেমেছে। টিসিবির উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা যায়। রমজান সামনে রেখে রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বাজার মনিটরিং ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা চলছে। যদিও বাজারে পণ্যমূল্য ইতোমধ্যেই অতিরিক্ত দামে বিক্রির প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রতিবছর রমজান আসার আগে অসাধু চক্র রোজার মাসের প্রয়োজনীয় পণ্য মসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, চিনি, মসলা, দুধ, শিশুদের গুঁড়োদুধ, ছোলা ও মাংসসহ ইফতারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের পণ্য আগাম আমদানির পর মজুদ করে। পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধির কথা বলে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে। এরপর তাদের চাহিদামতো অতিরিক্ত মূল্যে ওই সব পণ্য বেশি দামে বিক্রি করে। ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, ওয়াইজঘাট, ডাল পট্টি, চকমোগলটুলী, শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, কাওরানবাজার, মোহাম্মদপুর, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির জন্য আমদানিকৃত পণ্য মজুদ করে থাকে। এরপর নিজেদের ইচ্ছামতো বাজারে মূল্য বাড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করে। এ বছর রোজার মাস শুরুর এক মাস আগে থেকেই অনেক নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়ার যে চক্রান্ত শুরু করা হয়েছে তা ঠেকাতে চলছে গোয়েন্দা নজরদারি। গোয়েন্দা সূত্রমতে, রমজান আসার আগেই মূল্য বৃদ্ধি ঘটানোর পাঁয়তারা করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, ধান, চাল, মাংস, মরিচ, মসলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। রাজধানী ঢাকার বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনা, বরিশাল, খুলনায় ও আরও অনেক স্থানে বাজারে এখন ধানসহ বিভিন্ন চালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কিছুটা মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। বেড়েছে মসলার দামও। এছাড়াও অতিবৃষ্টি, হাওড়ের অকাল বন্যার অজুহাতে কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বেগুন, ঝিঙা, ঢেঁড়স প্রতিটি তরকারির দাম বাড়ছে। তরকারি বিক্রেতাদের মতে, হাওড় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া, অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্টসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে তরকারির দাম ইতোমধ্যে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাজারে গরু, খাসি, মুরগির মাংস বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা আগে থেকেই তা নিয়ন্ত্রণ করা এখনই জরুরী প্রয়োজন। রমজানের আগে বাজারে মূল্য বাড়ানো নিয়ে আবারও নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী রমজানে বেশি বিক্রি হয় এমন পণ্য আমদানির জন্য এলসি করেছে। এই এলসি খুলে রমজানের আগে পণ্য আমদানি করা হবে। পরে পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী যারা প্রথম শ্রেণীর আমদানিকারক বলে পরিচিত তারাই মূলত বিদেশ থেকে ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন ও ছোলার সিংহভাগই আমদানি করে থাকেন। এসব ব্যবসায়ীদের মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানিকারক, খুলনার পেঁয়াজ আমদানিকারক, ঢাকার মৌলভীবাজারের ডাল ও তেল আমদানিকারক, গুলশান এলাকার ডাল ও ছোলা আমদানিকারকের নাম সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরে এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। এই প্রভাব কাজে লাগিয়েই তারা ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ, ডাল, তেল, ছোলা ও পেঁয়াজ আমদানি করে মজুদ গড়ে তুলে থাকেন। অন্য কোন আমদানিকারক যেন এসব পণ্য আমদানি করতে না পারে সে জন্য কৌশলে তাদের ওপরেও তারা প্রভাব বিস্তার করেন। ফলে সিন্ডিকেটের বাইরের সাধারণ আমদানিকারকরা এখন আর এসব পণ্য আমদানি করতে পারেন না। এই সুযোগে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা রোজা শুরুর আগেই নিজেদের ইচ্ছামতো ডাল, ছোলা, তেল ও পেঁয়াজের দাম এক দফা বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার কারণে এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। রোজা শুরুর পরে তারা আরও দুই দফায় দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করার অতীত নজির থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। গায়েন্দা সূত্র জানায়, প্রতিবছর রমজান আসার আগে থেকেই রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ গুঁড়োদুধ, পোকা ধরা ছোলা, মসুর ডালসহ অনেক পণ্য কারসাজি করে বিক্রি করার সম্ভাবনা রয়েছে। পণ্য মজুদ রাখার গোডাউন তল্লাশি করলে পোকা ধরা বা নষ্ট হওয়া অনেক পণ্য সামগ্রী পাওয়া যাওয়ার বহু ঘটনা ঘটেছে অতীতে। অভিযোগ রয়েছে, কাঁচাবাজার বা পাইকারি কাঁচাবাজার থেকে বহু দূরে ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে গোপনে সেখানে পণ্য মজুত করছে। আর সময় সুযোগ হলে বাজার পরিস্থিতি বুঝে তা বেশি দামে বিক্রি করা হয়। দাম বাড়লে গোপন গোডাউন থেকে পণ্য বের করা হয়। দাম কমলে পণ্য মজুদ থাকে। এভাবে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকেই রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হওয়ার জন্য টার্গেট নিয়ে তারা তৎপরতা চালায়। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আছে, যারা রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে তারা গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় চলে এসেছে। রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে এখনই খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। ব্যবসায়ীসহ বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা শুরু করেছেন। গোয়েন্দা সদস্যরা ক্রেতার বেশে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ পাইকারি বাজারগুলোতে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। যেভাবেই হোক রমজানে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখাই হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্য। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সঠিক নিয়মে রোজার মাসের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এসব পণ্য আমদানি ও বিক্রি হলে বাজারে কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকার কথা নয়। প্রতিবছরই মনোপলি ব্যবসা বাগিয়ে নেয়ার জন্য তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়ে থাকে বলেই বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটে নেয়ার চেষ্টা করা হয়ে আসছে। রমজানে নিত্যপণ্যের মূল্য ঠিক রাখতে বাজার মনিটরিং করতে বাজারের ব্যবসায়ী সমিতি, কমিটি, ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বাজার নিয়ন্ত্রণমুখী নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
×