ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ প্রমাণিত ॥ সাফাতসহ ৫ আসামির বিরুদ্ধে শীঘ্রই চার্জশীট

বনানী থানার ওসিসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৪ মে ২০১৭

বনানী থানার ওসিসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের মামলা নিতে গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বনানী থানার ওসিসহ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এই মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে শীঘ্রই চার্জশীট দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এদিকে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের দামী মার্সিডিজ গাড়ি জব্দ করেছে শুল্ক ও গোয়েন্দা দল। অন্যদিকে রাজধানীর বনানীর দ্য রেইন ট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মাদক, ভ্যাট এবং শুল্ক আইনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে শুল্ক ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রাজধানীর বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের মামলা নিতে বিলম্ব, থানায় তাদের সঙ্গে অসদাচরণ ও সঠিক তদারকি না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরমান আলীসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। অপর অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা হচ্ছেন, বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন ও গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার। সোমবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। মোট ৭৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের ৭৪ পৃষ্ঠায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন। জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে গত ২৮ মার্চ রাতে রেইন ট্রি হোটেলে বন্ধুর যোগসাজশে ধর্ষণের শিকার হন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী। গত ৪ মে তারা থানায় মামলা করতে যান। তবে পুলিশ দুইদিন পর মামলা নেয়। ওই সময় বনানী থানার ওসির বিরুদ্ধে প্রভাবশালী আসামিদের রক্ষায় ২৫ লাখ টাকা নেয়া এবং ঘটনার শিকার তরুণীদের হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ তদন্তে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ওই কমিটির অপর সদস্যরা হচ্ছেনÑ ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন। সোমবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, মামলা নিতে গাফিলতি ছিল গৌণ। তবে কিছু ব্যত্যয় হয়েছে। মেজর কিছু না হলেও আইনের মাইনর কিছু ব্যত্যয় হয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, পুলিশের ওপর আস্থা রাখুন। কারও কোন আইনের ব্যত্যয় ঘটলে তার দায়িত্ব পুলিশ নেবে না। ন্যায়বিচার যেন নিশ্চিত হয়, সে জন্য কাজ করব। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মামলা করতে গিয়ে দুই তরুণী হয়রানির যে অভিযোগ করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। এ জন্য বনানী থানার ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত) এবং ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রভাবশালীদের আসামিদের বাঁচাতে ওসির মোটা অঙ্কের টাকা নেয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটির সূত্র জানায়, ঘটনার সময় গুলশান জোনের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ ছুটিতে ছিলেন। ওই সময় ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন মানস কুমার পোদ্দার। তিনি ঘটনাটি সঠিকভাবে তদারকি করেননি। ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ পাওয়ার পরও পুলিশের ওই কর্মকর্তা তার উর্ধতন কর্মকর্তাদের তা অবহিত করেননি। এ জন্য তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে বনানী রেইন ট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজন আসামির বিরুদ্ধে শীঘ্রই চার্জশীট দিচ্ছেন গোয়েন্দা পুলিশ ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার তদন্ত দল। সোমবার দুপুরে ডিএমপি সদর দফতরে নিজ কার্যালয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, এ মামলা ঘটনায় খুব দ্রুত চার্জশীট দেয়া হবে। রেইন ট্রির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে দ্য রেইন ট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মাদক, ভ্যাট এবং শুল্ক আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মঙ্গলবার রাজধানীর কাকরাইলের ইডিইবি ভবনে অবস্থিত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে রেইন ট্রি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য শোনার পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক মঈনুল খান। তিনি জানান, তারা আমাদের (রেইন ট্রি হোটেল) জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করব। তিনি জানান, রেইন ট্রি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিষয়ে অনিয়ম পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে মাদক, ভ্যাট এবং শুল্ক আইনে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারা হোটেলটি ৯ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার পর থেকে ১৪ মে পর্যন্ত অতিথিদের কাছ থেকে ভ্যাটের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করলেও সরকারী তহবিলে জমা দিয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। অথচ এটাকে তারা নিজেদের লাভ বা প্রফিট হিসেবে দেখিয়েছে। শুল্ক অধিদফতরের হিসেবে এই সময়ে তারা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৮ লাখ ২৭ হাজার টাকার। তাই এটা আত্মসাতের পর্যায়ে পড়ে। এছাড়াও গত ১৪ মে হোটেলটিতে পরিচালিত অভিযানের সময় যে ১০ বোতল বিদেশী মদ উদ্ধার হয় সেগুলোকে তারা জুস বলে দাবি করে এতদিন আইনী লড়াই চালিয়েছিল। কিন্তু এই মদের স্যাম্পল (নমুনা) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে বলা হয়েছে, এসব পানীয়তে ১৩.৫% এ্যালকোহল রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোন পানীয়তে এ্যালকোহলের উপস্থিতি ৫%-এর বেশি হলে তাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডিজি মাঈনুল জানান, আগে তারা এটি স্বীকার না করলেও আজ (মঙ্গলবার) জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে ওই ১০ বোতল বিদেশী মদ ছিল। তাই তাদের বিরুদ্ধে এ বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব মদের বৈধ কোন কাগজ না থাকায় তারা চোরাচালানের মাধ্যমে এসব মাদকদ্রব্য এনে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। মঈনুল খান জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আজ (মঙ্গলবার) রেইন ট্রির লোকজন দাবি করেছে, এসব মদ অতিথিরা এনেছিল। তবে তারা চলে যাওয়ার সময় এগুলো রেখে যায়। এরপর তা হোটেলটির ১০১ নম্বর কক্ষে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই এগুলো উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে জানায়নি। ফলে এটাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। ডিজি জানান, রেইন ট্রি কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই মূল ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কাল (সোমবার) তার সর্বশেষ আদালতে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিন্তু শুল্ক অধিদফতরের পাল্টা চ্যালেঞ্জের কারণে আজ (মঙ্গলবার) তারা এখানে হাজির হতে বাধ্য হন। হোটেল রেইন ট্রি থেকে উদ্ধার করা মদকে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে উল্লেখ করে ডিজি মঈনুল জানান, যেহেতু বনানীর দুই তরুণীকে ধর্ষণ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তাদের (ভিকটিম) জোর করে মদ খাওয়ানো হয়েছিল। তাতে এটা প্রমাণিত যে রেইন ট্রি হোটেলে এর আগেও মদ আগেও বিক্রি হয়েছে এবং ঘটনার সময়েও ব্যবহার হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি বনানীতে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি ওই বিষয়ে আরও তথ্য জানতে দ্য রেইন ট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান হারুন, জেনারেল ম্যানেজার ফ্রাংক ফরগেট, গুলশান জোনের ডিসি মোশতাক আহমেদ ও বনানী থানার ওসি ফরমান আলীকে তলব করেছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ওই ঘটনার ব্যাপারে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে এই তলব নোটিশ পাঠায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
×