ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ

রিয়াদ সম্মেলনে অংশ নেয়ায় জনশক্তি রফতানির পথ প্রশস্ত হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৪ মে ২০১৭

রিয়াদ সম্মেলনে অংশ নেয়ায় জনশক্তি রফতানির পথ প্রশস্ত হবে

তৌহিদুর রহমান ॥ রিয়াদ ঘোষণা অনুযায়ী ইরাক ও সিরিয়ার সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে পাশে থাকলেও সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ। সৌদি আরবে শুধুমাত্র মক্কা-মদিনার পবিত্র দুই মসজিদ আক্রমণ হলেই বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাতে পারে। এছাড়া অন্য কোন জোটে বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী নয়। আর রিয়াদ সম্মেলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে সৌদি আরবে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির পথ আরও প্রশস্ত হতে পারে। এদিকে কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিয়াদ সম্মেলনে ইরান বিরোধী ঘোষণায় ঢাকা-তেহরান সম্পর্কে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এছাড়া আরব-আমেরিকা সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দেয়ায় রিয়াদ-ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক আরও গভীর হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। সৌদি আরবের রিয়াদে গত রবিবার অনুষ্ঠিত আরব-আমেরিকা সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে বক্তব্যও রাখেন। তিনি এই সম্মেলনে বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থান তুলে ধরেছেন। রিয়াদ সম্মেলনে বিশ্বের ৫৬টি দেশ অংশগ্রহণ করেছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে যে সামরিক জোট গঠন করা হয়, প্রধানত সেই জোটের দেশগুলোই এই সম্মেলনে অংশ নেয়। তবে এই সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যোগ দেয়ায় আরব-আমেরিকা সম্মেলনের এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ের পর এই প্রথমবারের মতো কোন দেশে সম্মেলনে যোগ দিলেন। রিয়াদ ঘোষণায় ইরাক ও সিরিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেখানে অভিযানের জন্য প্রায় ৩৫ হাজারের বেশি সৈন্যের একটি বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। তবে ঢাকা ও রিয়াদের কূটনীতিকরা বলছেন, রিয়াদ ঘোষণা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের যৌথ উদ্যোগে সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা হলেও বাংলাদেশ সেখানে সেন্য পাঠাতে আগ্রহী নয়। সৌদি আরবে শুধুমাত্র মক্কা-মদিনার পবিত্র মসজিদ আক্রমণ হলেই বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাতে পারে। এছাড়া জাতিসংঘের নেতৃত্বে কোন জোট হলে সেখানে বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাবে। তবে অন্য কোন জোটে বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী নয়। ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে আইএস বিরোধী সামরিক জোটে যোগ দেয় বাংলাদেশ। আইএসবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব একযোগে কাজ করবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। আইএসবিরোধী জোটে থেকে সন্ত্রাস প্রতিরোধে তথ্য বিনিময়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে যুক্ত থাকবে বাংলাদেশ। তবে সরাসরি সেই জোটে সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ। ঠিক একইভাবে রিয়াদ ঘোষণা অনুযায়ী ইরাক-সিরিয়ার সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়েও সৈন্য পাঠাতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশ। এই জোটেও বাংলাদেশ তথ্য বিনিময়, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় ইত্যাদি কাজে যুক্ত থাকতে চায়। সূত্র জানায়, শ্রম বাজারের দিক থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী কর্মী কাজ করছেন। দেশটির শ্রম বাজারে আধা দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ সৌদিতে আরও বেশি হারে জনশক্তি রফতানি করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্যে দিয়ে সেদেশে জনশক্তি রফতানির পথ আরও প্রশস্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। রিয়াদ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. ওয়ালিউর রহমান মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, সৌদি আরবে আরব-আমেরিকা সম্মেলনে যোগ দেয়াটা বাংলাদেশের জন্য সঠিক ও ইতিবাচক পদক্ষেপ। সৌদি আরবের এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। বরং বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থান আরও জোরালো হয়েছে। ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের অনেক জঙ্গী সংগঠনের অর্থ আনার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে জেএমবির বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ বেশি। এছাড়াও আরও অনেক সংগঠন আছে, যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ এনেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মেলনে যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জঙ্গীদের প্রভাব কমবে। তিনি বলেন, সৌদি সম্মেলন থেকে ইরান বিরোধী যেসব ঘোষণা এসেছে, সে ঘোষণায় বাংলাদেশ ও ইরান সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশ সব সময় জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। আগামীতেও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই অগ্রসর হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, সৌদি আরব-আমেরিকা সম্মেলনে অংশ নেয়ার ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে বলেও তিনি মনে করেন। রিয়াদ সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, সৌদি আরব-আমেরিকা সম্মেলনে ইরান বিরোধী যেসব কথা আসছে, সেখানে ইরান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কেননা-ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ইরান সেটা বোঝেও। চীন-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুব ভাল নয়। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরব ও ইরানের সঙ্গেও বাংলাদেশের সমান সুম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, মুসলিম বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় পাকিস্তান। দেশটি অনেক দিন ধরেই সেই চেষ্টা করছে। তবে বিভিন্ন ইসলামী সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের যে সম্পর্ক গড়ে উঠছে, সেজন্য পাকিস্তানের অপচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান আরও মজবুত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, অনেক আগে থেকেই জনশক্তি রফতানির জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর একটি সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সেজন্যই সৌদি আরবকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই এই সম্মেলনও সৌদি আরব আয়োজন করলে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই এতে সাড়া দিয়েছে। উল্লেখ্য, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে রবিবার প্রথম আবর-আমেরিকা ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হওয়া এ সম্মেলনে অংশ নেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আরব এবং মুসলিম বিশ্বের ৫৫ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদ। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্যরে সম্প্রসারণ এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের প্রচেষ্টা জোরদার করাই ছিল এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য। এ সম্মেলনে অংশ নেন- কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব-আমিরাতের আমীর, বাহরাইনের বাদশাহ, ব্রুনাই দারুসসালামের সুলতান, মিশর, উজবেকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বেনিন, লেবানন, মৌরিতানিয়া, তিউনেশিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক ও নাইজারের প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, আলজেরিয়া পার্লামেন্টের চেয়ারম্যান, উগান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এদিকে রিয়াদ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকা পৌঁছেছেন।
×