ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিন বছরে বিমানের ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা;###;লিজ প্রক্রিয়া বন্ধ করে নতুন বিমান কেনার সুপারিশ

লিজ নেয়া দুই উড়োজাহাজ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ॥ মাসে গচ্চা ৯ কোটি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৪ মে ২০১৭

লিজ নেয়া দুই উড়োজাহাজ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ॥ মাসে গচ্চা ৯ কোটি

কাওসার রহমান॥ ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজ নেয়া দুটি উড়োজাহাজ নিয়ে তুঘলকি কা- ঘটছে। লিজ নেয়ার এক বছরের মাথায় দুটি উড়োজাহাজের সব কটি ইঞ্জিন একের পর এক নষ্ট হয়ে যায়। গ্রাউন্ডেড হয়ে থাকা এই উড়োজাহাজের জন্য প্রতিমাসে বিমানকে ৫ কোটি টাকা এবং ভাড়ায় আনা দুটি ইঞ্জিনের জন্য প্রতিদিন ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। গত ৫ মাস ধরে পুরোপুরি গ্রাউন্ডেড হয়ে থাকা উড়োজাহাজ দুটির পেছনে গত তিন বছরে বিমানের ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা। বিমান ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মুনাফা করেছে ২৭৫ কোটি টাকা। এই ক্ষতি বিমানের ওই মুনাফার চাইতেও বেশি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি কর্তৃক গঠিত এক সাবকমিটির রিপোর্টে এই তুঘলকি কা-ের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ বিমানের লিজকৃত উড়োজাহাজ দীর্ঘদিন গ্রাউন্ডেড থাকার কারণ অনুসন্ধানে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, লিজের মাধ্যমে অলাভজনক অপ্রচলিত উড়োজাহাজ নেয়ার কারণে সব কটি ইঞ্জিন এক বছরের মাথায় একের পর এক নষ্ট হয়ে যায়। এই ধরনের উড়োজাহাজ কেন ভাড়া নেয়া হলো সেটা অত্যন্ত রহস্যজনক। বিমানের মতো জাতীয় পরিবহন সংস্থাকে এত বড় ক্ষতির মুখে ফেলার কারণও উদঘাটন প্রয়োজন। তাই উড়োজাহাজ দুটির চুক্তির সঙ্গে যারা জড়িত তারা কেন, কোন্ উদ্দেশে, কোন্ পরিস্থিতিতে, কি বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ বিমানের স্বার্থে উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেয়া লাভজনক মনে করলেন তা কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে লিখিত আকারে বক্তব্য প্রদান করা উচিত। বিমানকে যদি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হয় তাহলে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সাবকমিটি তাদের এই প্রতিবেদন সোমবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করে। বৈঠকে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে কারিগরি বক্তব্য সন্নিবেশ করে রিপোর্টটি চূড়ান্ত করতে আরও ১৫ দিন সময় দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সৌদি আরব যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেও প্রতিবেদনের একটি কপি পৌঁছেছে। বিমানের লিজ নেয়া উড়োজাহাজ বিকল হওয়ায় এবং বসিয়ে রেখে প্রতিমাসে ৫ কোটি টাকা করে ভাড়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বলেন, ‘রিপোর্টটি আমরা হাতে পেয়েছি। প্রাথমিকভাবে রিপোর্টে কিছু ঘাটতি দেখা গেছে। ইঞ্জিন মেরামতে কেন এত সময় লাগছে সে ব্যাপারে কারিগরি বক্তব্য থাকা উচিত। তাই ওই ঘাটতি পূরণ করার জন্য আমরা ১৫ দিনের সময় দিয়েছি।’ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, গত ১০ এপ্রিল নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এ সাবকমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন নীলফামারী-১ আসনের সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার এবং মহিলা আসন-৪৭’র সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান। রিপোর্টের পর্যালোচনা থেকে গ্রাউন্ড হয়ে থাকা এয়ার হতে লিজ নেয়া উড়োজাহাজের চমকপ্রদ কাহিনী বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে বিমান লিজ নেয়ার নামে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের মারাত্মক সব কাহিনী। বিমান বহরে এ ধরনের আত্মঘাতী লিজের মাধ্যমে সংগৃহীত আর কোন উড়োজাহাজ আছে কিনা সে ব্যাপারে কমিটি কঠোর দৃষ্টি দেয়ার সুপারিশ করেছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের আত্মঘাতী লিজের মাধ্যমে বিমানবহরে যাতে আর কোন উড়োজাহাজ সংযুক্ত না হয় সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখার সুপারিশ করেছে। উড়োজাহাজ লিজ আনতে যে খরচ হয় তার কাছাকাছি ব্যয়ে একটি নতুন বিমান ক্রয় করা সম্ভব। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের লিজ প্রক্রিয়া বন্ধ করে নতুন বিমান কেনার জন্য বিমান কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া সুপারিশ করা হয়, ভবিষ্যতে বিমানের স্বার্থের পরিপন্থী আত্মঘাতী এ ধরনের চুক্তি যাতে সম্পাদিত না হয় বিমান কর্তৃপক্ষ তা নিশ্চিত করবে এবং এ ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই বিস্তারিত অবগত ও অনুমোদন নেবে। পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালের ২০ মার্চ এবং ৫ মে ইজিপ্ট এয়ার থেকে ৫ বছরের জন্য ড্রাই লিজ চুক্তির আওতায় দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়া হয়। ভাড়া নেয়ার আগে একাধিক দল উড়োজাহাজ দুটি পরিদর্শনপূর্বক দরপত্রে উল্লেখিত শর্ত অনুযায়ী উড়োজাহাজ দুটির ইঞ্জিনের কারিগরি অবস্থা এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে চুক্তি সম্পাদনের পক্ষে মতামত দেয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইজিপ্ট এয়ার কর্তৃক উড়োজাহাজ দুটির সি-চেক চলাকালে বিমানের আরও একটি প্রতিনিধি দল সকল মেরামত সুষ্ঠুভাবে হয়েছে তা নিশ্চিত হয়ে বিমানের পক্ষে উড়োজাহাজ দুটি গ্রহণ করে। অথচ ভাড়া নেয়ার ১১ মাস যেতে না যেতেই ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজের (এস২-এএইচএল) এক নম্বর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। মারাত্মক ত্রুটির জন্য তা সহজে সারানো সম্ভব না হওয়ায় এবং স্পেয়ার্স ইঞ্জিন না থাকায় উড়োজাহাজটি তিন মাসের জন্য গ্রাউন্ডেড হয়। উল্লেখ্য, নষ্ট হয়ে যাওয়া ওই মডেলের ইঞ্জিনের ব্যবহার অত্যন্ত কম হওয়ায় অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের কাছে এই স্পেয়ার্স ইঞ্জিন মজুদ আছে। ফলে উড়োহাজাজটি সচল করতে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ ইজিপ্ট এয়ার থেকে একটি ইঞ্জিন লিজ নিয়ে উড়োজাহাজটি সচল করা হয়। কিন্তু মাত্র ২০ দিনের মাথায় ৪ এপ্রিল পুনরায় উড়োজাহাজটির দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন দুটি ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল ও ২ জুলাই মেরামতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে পাঠানো হয়। মেরাতম শেষে ২০১৬ সালের ২৩ জুন ও ২৬ আগস্ট ইঞ্জিন দুটি উড়োজাহাজে সংযুক্ত করা। এখানে দেখা যায়, ইঞ্জিন দুটি মেরামত করতে সময় লেগেছে ১৪ মাস ও ১৩ মাস। এবার দ্বিতীয় উড়োজাহাজের কথায় আসা যাক। লিজ নেয়ার মাত্র ১৭ মাসের মাথায় দ্বিতীয় উড়োজাহাজের (এস২-এএইচকে) প্রথম ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। ফলে পুনরায় ইঞ্জিপ্টএয়ার থেকে ২০১৫ সালের ১১ মে আরও একটি ইঞ্জিন (তৃতীয় ইঞ্জিন) লিজ আনা হয়। এই ইঞ্জিনটিও ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ নষ্ট হয়ে যায় এবং তা মেরামতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে পাঠানো হয়। প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও ইঞ্জিনটি এখনও মেরামত হয়ে ফেরত আসেনি। এছাড়া দ্বিতীয় উড়োজাহাজের দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও নিয়মিত মেরামতের জন্য ২০১৬ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে পাঠানো হয়েছে এবং এখনও তা ফেরত আসেনি। ফলে দ্বিতীয় বিমানটি গ্রাইন্ডেড হয়ে পড়ে। এদিকে প্রথম উড়োজাহাজের জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকে ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনটি ফেরত দিতে গিয়ে বিমান ফ্যাসাদে পড়েছে। ২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট ইঞ্জিনটি ফেরত দিতে গেলে তা গ্রহণে ইজিপ্ট এয়ার অস্বীকৃতি জানায়। তারা ইঞ্জিন ফেরতের শর্ত অনুযায়ী, ইঞ্জিনের এইচপিসি ব্লেডে ত্রুটি খুঁজে বের করে তা মেরামত করে ফেরত দিতে বলে। বিমান প্রথমে তাতে সম্মত না হওয়ায় ইজিপ্ট এয়ার কর্তৃপক্ষ কায়রো বিমানবন্দরে তাদের কাছ থেকে লিজ নেয়া প্রথম উড়োজাহাজটি আটকে রাখে। এবং বিমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইঞ্জিন মেরামত করে ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার আদায় করে। চুক্তি অনুযায়ী বিমান তাতে সম্মত হয় এবং ইঞ্জিনটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে মেরামতের জন্য পাঠায়। ইঞ্জিনটির মেরামতের কাজ ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর শুরু হয়ে এখনও চলছে। এজন্য বিমানকে অকারণে ইঞ্জিন বাবদ প্রতিদিনের জন্য ৮ হাজার ডলার করে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এখানেই লিজ নেয়া উজোজাহাজের কাহিনী শেষ নয়। নিয়মিত ‘বোরেস্কপি ইন্সপেকশনের’ সময় লিজকৃত দুটি উড়োজাহাজের দুটি ইঞ্জিনের ‘ইন্টারনাল হার্ডওয়্যারের’ অস্বাভাবিক ক্রমাবনতি দেখা যায়। ফলে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বিমান ওই ইঞ্জিন দুটি ইজিপ্ট এয়ারকে ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ইজিপ্ট এয়ার থেকে নেয়া দুটি উড়োজাহাজই গ্রাউন্ডেড অবস্থায় আছে। কমিটি যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছে ভাড়া গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ যে উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেবে সেটা প্রচলিত না অপ্রচলিত উড়োজাহাজ, ইঞ্জিনসহ যান্ত্রিকভাবে কতটুকু সক্ষম, সেটা থেকে কী ধরনের সার্ভিস পাওয়া যাবে, উড়োজাহাজগুলো কত দিনের পুরনো, স্পেয়ার পার্টসসহ ইঞ্জিন সহজলভ্য কি-না, যদি মেরামতের প্রয়োজন হয় তবে সেটা কতটা ব্যয়বহুল, মেরামত স্থানীয়ভাবে না অন্য কোথাও পাঠিয়ে করতে হবে এবং তা কতটুকু সময়সাপেক্ষ হবে, লিজ চুক্তি সম্পাদনের আগে তা বিবেচনায় আনা হয়নি। যদি বিবেচনায় নেয়া হতো তাহলে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন সহজলভ্য নয়, স্পেয়ার পার্টস পাওয়া যায় না, মেরামতের জন্য যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় না, পুরনো উড়োজাহাজের স্পেয়ার পার্টস যা নতুন উড়োজাহাজের পার্টসের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়, সে ধরনের উড়োজাহাজ লিজ নেয়া হতো না। ফলে আজকের মতো এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হতো না। এ ধরনের অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের পেছনে অন্য কোন কারণ অন্তর্নিহিত আছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। এছাড়া অলাভজনক অপ্রচলিত উড়োজাহাজ যার সবকটি ইঞ্জিন এক বছরের মাথায় একের পর এক নষ্ট হয়ে যায়, সে ধরনের উড়োজাহাজ কেন ভাড়া নেয়া হলো সেটা অত্যন্ত রহস্যজনক। বিমানের মতো জাতীয় পরিবহন সংস্থাকে এতবড় ক্ষতির মুখে ফেলার কারণও উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। তাই উড়োজাহাজ দুটির চুক্তির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কেন, কোন উদ্দেশ্যে, কোন পরিস্থিতিতে কী বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ বিমানের স্বার্থে উক্ত উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেয়া লাভজনক মনে করলেন তা কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে লিখিত আকারে বক্তব্য প্রদান করা উচিত। বিমানকে যদি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হয় তাহলে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একটি উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার প্রথম ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং মেরামত করতে না পেরে আবার ভাড়ায় ইঞ্জিন আনা এবং অন্য কোথাও না পেয়ে একই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইঞ্জিন ভাড়া আনা এবং ওই ইঞ্জিন লাগানোর কিছুদিনের মধ্যে আবার দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয় ইঞ্জিনও আবার ভাড়ায় আনা- এটাই প্রমাণ করে যে, ওই উড়োজাহাজের দুটি ইঞ্জিনই বিকল ছিল এবং কোনমতে চলার উপযোগী করে ভাড়া দেয়া হয়েছিল। পর্যালোচনায় আারও দেখা যায়, বি৭৭৭-২০০ইআর উড়োজাহাজের ইঞ্জিন মেরামতের খরচ ছিল সর্বোচ্চ ৬১ লাখ ২৪ হাজার ডলার। কিন্তু খরচ হয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ১৮ হাজার ৭৭১ ডলার। তেমনি এ উড়োজাহাজের দ্বিতীয় ইঞ্জিনটির মেরামতের খরচ ধরা ছিল সর্বোচ্চ ৬১ লাখ ২৪ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খরচ হয়েছে দুই কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৩৯ ডলার। এ খরচ কোনভাবেই কমিটির কাছে বোধগম্য নয়। তদন্ত কমিটির প্রশ্ন হলো, যদি সক্ষম ইঞ্জিনসহ উড়োজাহাজ লিজ নেয়া হতো তবে এত তাড়াতাড়ি এভাবে সব নষ্ট হয়ে গেল কেন? লিজকৃত উড়োজাহাজ দুটির অপাারেশনাল সাপোর্ট দেয়ার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকে মাসিক ১০ হাজার ডলারের বিনিময়ে চার জনের ইঞ্জিনিয়ারিং টিম আনা হয়। বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের যে উড়োজাহাজের অপারেশন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই, বাইরে থেকে ভাড়ায় লোক আনতে হয়, সে ধরনের উড়োজাহাজ লিজে আনার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এতসব জেনেও বিমান কর্তৃপক্ষ লিজের মাধ্যমে উড়োজাহাজ দুটি সংগ্রহ করে। ইঞ্জিন মেরামতের সময় মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানকে মেরামত করে ফেরত দেয়ার কোন সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়নি। যদি ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ১২-১৩ মাস সময় লাগে সেক্ষেত্রে উড়োজাহাজ দুটির ভাড়ার পাশাপাশি ইঞ্জিনেরও ভাড়া দিতে হয়েছে বিমানকে। এখানে বিমানের স্বার্থ কোনভাবে রক্ষা হয়নি। এক্ষেতে সব দিক দিয়ে খেসারত দিতে হচ্ছে বিমানকে আর লাভ হয়েছে ভাড়া প্রদানকারী সংস্থার। উড়োজাহাজ দুটি লিজ নেয়ার পর গত তিন বছরে বিমানের এ লিজ বাবদ ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ‘ফোর্স মেজরের’ মাধ্যমে কেন গ্রাউন্ডেড বিমান দুটি ফেরত দেয়া হচ্ছে না তা রহস্যজনক। চুক্তি অনুযায়ী, চার বছর পর উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দিতে হলে বিমানকে আরও ৫৬ কোটি টাকা লোকসান দিতে হবে। ফলে দুটি উড়োজাহাজ লিজ বাবদ বিমানের ক্ষতি দাঁড়াবে ৩৬১ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭৫ কোটি টাকা লাভ করে বিমান যে সাফল্য অর্জন করেছে উড়োজাহাজ দুটির লোকসানের মধ্য দিয়ে তা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কমিটির সুপারিশ ভবিষ্যতে এ ধরনের আত্মঘাতী লিজের মাধ্যমে বিমানবহরে যাতে আর কোন উড়োজাহাজ সংযুক্ত না হয় সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখার সুপারিশ করেছে কমিটি। উড়োজাহাজ লিজ আনতে যে খরচ হয় তার কাছাকাছি ব্যয়ে একটি নতুন বিমান ক্রয় করা সম্ভব। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের লিজ প্রক্রিয়া বন্ধ করে নুতন বিমান কেনার জন্য বিমান কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া সুপারিশ করা হয়, ভবিষ্যতে বিমানের স্বার্থের পরিপন্থী আত্মঘাতী এ ধরনের চুক্তি যাতে সম্পাদিত না হয় বিমান কর্তৃপক্ষ তা নিশ্চিত করবে এবং এ ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই বিস্তারিত অবগত করবে ও অনুমোদন নেবে। চুক্তি সম্পাদনের আগে বিশেষজ্ঞ কমিটি যে যে ক্ষেত্রে নিরীক্ষা করে এ উড়োজাহাজ দুটি ভাড়া নেয়ার যুক্তি উপস্থাপন করেছিল, সে কারিগরি মতামত লিখিত আকারে মূল কমিটির কাছে উপস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। বিমান পরিচালনা পর্ষদ কী বিবেচনায় এ লিজ চুক্তির পক্ষে অনুমতি দিয়েছিল তা তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদকে মূল কমিটিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখিত বক্তব্য নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। লিজকৃত উড়োজাহাজ গ্রহণ করার পর উড়োজাহাজ চলুক বা না চলুক পূর্ণ মেয়াদে ভাড়া প্রদান করতে হবে এবং ছোট বড় যাবতীয় মেরাতম বিমানকেই বহন করতে হবে এ ধরনের শর্তের পেছনে যুক্তি কী ছিল? সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা আর্থিক ক্ষতি হয় এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নজর রাখা উচিত ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের দায়িত্ব ছিল বা আছে বলে পরিলক্ষিত হয়নি। এ বিষয়ে চরম উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে আরও অধিক মনোযোগী এবং কর্তব্যে অবহেলা ঘটে থাকলে সে ব্যাপারে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
×