ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অসহায় সালমা শেষ অবধি বিচার পেল গ্রাম আদালতে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ মে ২০১৭

অসহায় সালমা শেষ অবধি বিচার পেল গ্রাম আদালতে

আরাফাত মুন্না ॥ ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় সালমার। স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে ১৬ বছর বয়সে দেড় বছরের সন্তান কোলে নিয়ে সালমা চলে আসে মায়ের সংসারে। হয়রানি আর আর্থিক অনটনের কারণে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি সালমা। পরে ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) বিচার চায় সে। গ্রাম আদালতে সালমার অভিযোগটির নিষ্পত্তি হয়। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে গত বছর ৬ জানুয়ারি সালমার অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। শুধু এই ইউনিয়নই নয়। বর্তমানে সারা দেশের এক হাজারেরও বেশি ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে সালমার মতো শত শত অসহায় মানুষের অভিযোগের নিষ্পত্তি হচ্ছে। এতে দেশের আদালতগুলোতে কমছে মামলার চাপ। থানাগুলোতেও তদন্তের চাপ কমছে। আর বিচার প্রার্থীদের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে দুটিই। বিচারব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে নেয়া নানা পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে শুরু করা হয়েছিল গ্রাম আদালত প্রকল্প। এই পাইলট প্রকল্পের সফলতার কারণে তিন গুণ বেশিসংখ্যক ইউনিয়নকে সম্পৃক্ত করে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প। প্রকল্পের দাফতরিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচারব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদের এ্যাকটিভেটিং ভিলেজ কোর্টস ইন বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এ পাইলট প্রকল্পটি দেশের ১৪টি জেলার ৫৭টি উপজেলার ৩৫১টি ইউনিয়নে বাস্তবায়ন করা হয়। পাইলট প্রকল্পের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যার মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের এ প্রকল্পের আওতায় থাকছে দেশের ৮টি বিভাগের ২৭টি জেলার ১২৮টি উপজেলার এক হাজার ৮০টি ইউনিয়ন। এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছেÑ ফরিদপুর, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রংপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬৫ দশমিক ২৯ কোটি টাকা। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট জাহিদ ইমাম বলেন, গ্রাম আদালত অধিক সক্রিয় হওয়ার কারণে উচ্চ আদালতসহ দেশের আদালতে মামলাজটের যে চাপ রয়েছে, তা অনেকটা কমবে। এ ছাড়া কোন ঘটনা ঘটলেই স্থানীয়ভাবে মীমাংসা না করে আদালতে মামলা করার যে প্রবণতা প্রান্তিক জনগণের মধ্যে রয়েছে, গ্রাম আদালত সেই প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করবে। এতে করে প্রচলিত ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনার আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে তৃণমূলের জনগণ মুক্তি পাবে। প্রকল্পের দাফতরিক সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সুসংগঠিত গ্রাম আদালতের মাধ্যমে স্থানীয় বিচারিক চাহিদা এবং যথাযথ আইনী সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অধিকতর সংবেদনশীল করা এবং স্থানীয় জনগণের বিশেষ করে নারী, দরিদ্র ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন করা। যাতে তারা তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায়গুলোর প্রতিকার চাইতে পারে এবং স্থানীয় পর্যায়ে দ্রুততম সময়ে, স্বল্প খরচে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। গ্রাম আদালত আইনের আওতায় ‘গ্রাম আদালত বিধিমালা’ অনুমোদন পাওয়ায় বিচার সংশ্লিষ্টদের অধিক সুবিধা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প এলাকার এক হাজার ৮০টি ইউনিয়নের বাইরে এক হাজার ৮৭৪ ইউনিয়নে গ্রাম আদালত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ২২ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিতরণ করেছে। এ ছাড়া দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারী এবং বেসরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে ২৭ জেলায় ২৭টি জেলা প্রশিক্ষণ দল (ডিস্ট্রিক্ট ট্রেনিং পুল) তৈরি করা হয়েছে। এনআইএলজির মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের প্রধান কর্মসূচী হচ্ছে এক হাজার ৮০টি ইউনিয়নে চেয়ার- টেবিলসহ এক হাজার ৮০ এজলাস বিতরণ করা, এক হাজার ৮০ ইউনিয়নে এক হাজার ৮০ গ্রাম আদালত সহকারী নিয়োগ দেয়া, এক হাজার ৮০টি ইউনিয়নে একটি করে গ্রাম আদালত সাইনবোর্ড স্থাপন করা, গ্রাম আদালত বিধিমালা-২০১৬ অনুসারে এক হাজার ৮০টি ইউনিয়নে প্রয়োজনীয় ফরমেট এবং রেজিস্ট্রার বিতরণ করা, এক হাজার ৮০ ইউপি চেয়ারম্যান, এক হাজার ৮০ ইউপি সচিব, ১২ হাজার ৯৬০ ইউপি সদস্য ও ১০ হাজার ৮০০ গ্রাম পুলিশ ও এক হাজার ৮০ গ্রাম আদালত সহকারীকে গ্রাম আদালত আইন ও গ্রাম আদালত বিধিমালা-২০১৬-এর ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া, ট্রেনিং ম্যানুয়েল, ফ্লিপ চার্ট প্রভৃতি সংশোধন করা এবং এনআইএলজির প্রশিক্ষণ কারিকুলামে গ্রাম আদালত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারী এবং বেসরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে ২৭ জেলায় ২৭টি জেলা প্রশিক্ষণ দল (ডিস্ট্রিক্ট ট্রেনিং পুল) তৈরি করা, ২৭টি জেলায় জেলা গ্রাম আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটি ও উপজেলা পর্যায়ে ১২৮ উপজেলা গ্রাম আদালত ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা এবং জ্ঞান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক হাজার ৮০টি ইউনিয়নে দুই লাখ ৭৫ হাজার উঠান বৈঠক আয়োজন করা। প্রকল্পের দাফতরিক সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯-১৫ মেয়াদে বাস্তবায়িত পাইলট প্রকল্পের প্রধান অর্জনগুলো হচ্ছে, ৩৫১টি ইউনিয়নে ৩৫১টি এজলাস, প্রয়োজনীয় ফরম এবং রেজিস্ট্রার বিতরণ, ৩৫১ ইউপি চেয়ারম্যান, ৩৫১ ইউপি সচিব, চার হাজার ২১২ ইউপি সদস্য ও তিন হাজার ৫১০ গ্রাম পুলিশ ও ৩৫১ গ্রাম আদালত সহকারীকে ‘গ্রাম আদালত আইন ও গ্রাম আদালত বিধিমালা’-এর ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান, দায়েরকৃত ৮৭ হাজার ২০০ মামলার মধ্যে ৬৯ হাজার মামলা, নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ৬১ হাজার ২০০ মামলার, মামলার চাপ কমাতে গ্রাম আদালতে বিচারযোগ্য ৬ হাজার ২০০ মামলা নিষ্পত্তি জন্য জেলা আদালত হতে গ্রাম আদালতে প্রেরণ, ২১ হাজার ৭০০ নারীর গ্রাম আদালতের মাধ্যমে বিচারিক সেবা নেয়া, গ্রাম আদালত প্যানেলে নারীদের অংশগ্রহণ ৮ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে বৃদ্ধি পাওয়া, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ বাবদ তিন কোটি ৭৯ লাখ টাকা আদায় করে দেয়া। এ্যাকটিভেটিং ভিলেজ কোর্টস ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের ন্যাশনাল প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সরদার এম আসাদুজ্জামান বলেন, আমরা যেসব ইউনিয়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি, তার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নগুলোর জনগণও গ্রাম আদালত সেবা সম্প্রসারণের দাবি করছেন। তা ছাড়া আশার কথা হচ্ছে, এ প্রকল্পের সফলতার কারণেই সরকার সারা দেশে গ্রাম আদালত সেবা বাস্তবায়নের প্রতি নজর দিচ্ছেন। এর ফলে চলতি বাজেটে উন্নয়ন খাত থেকে গ্রাম আদালতের জন্য পৃথক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, প্রকল্প সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলেও সারা দেশের গ্রাম আদালতগুলো সক্রিয় হবে এবং সেবা অব্যাহত থাকবে।
×