ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিচার বিভাগ অকেজো হয়ে যাচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায় ॥ সিনহা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ মে ২০১৭

বিচার বিভাগ অকেজো হয়ে যাচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায় ॥ সিনহা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আইন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে বিচার বিভাগ অকেজো হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। রবিবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানির সময় তিনি এমন মন্তব্য করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, এটা আপনি সরকারকে বলবেন সমাধানের জন্য। আমি ওপেন কোর্টে বলতে চাই, বিচার বিভাগ সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আপনি আপনার সরকারকে বলে দেবেন, আইন মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে বিচার বিভাগ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। এরপর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় ২ জুলাই পর্যন্ত স্থ’গিত করে আদেশ দেন আপীল বিভাগ। রাষ্ট্রপক্ষের করা রায় স্থগিতের আবেদনের শুনানি নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের সাত বিচারকের বেঞ্চ রবিবার এ আদেশ দেন। এদিকে আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের পর কয়দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্ধ থাকায় ৩৭টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত না থাকলে ইভটিজিং বেড়ে যায়, দখল বেড়ে যায়, খাদ্যে ভেজাল বেড়ে যায়। তাছাড়া আসন্ন রোজায় ভেজালবিরোধী অভিযানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা হয়েছে।’ রবিবার মামলাটি শুনানির জন্য এক নম্বর থাকলেও আদালত ১০টা ৫ মিনিটে বসে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন উপস্থাপনের পর আদালত বলেন, দরখাস্তে কি দেখাতে চেয়েছেন। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মোবাইল কোট ৪ দিন বন্ধ ছিল। এর মধ্যে দিনাজপুরে ৩৭টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি কি প্যারালাল কোর্ট চান? জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না, ইমিডেয়েটলি ইফেক্টের জন্য। যে কোন অপরাধের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার জন্য। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট করে শাস্তি দেবেন। আবার তার বিচার করবেন। এটা কোন বিধানে করবেন?’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘একজন দোষ স্বীকার করলেই তাকে সাজা দেয়া হয়।’ প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, ‘আপনারা বাড়াবাড়ি করেছেন। বাড়াতে বাড়াতে এক মাইল নিয়ে গেছেন। বাকি শুধু ৩০২ (দ-বিধিতে হত্যা মামলার ধারা)। একজন দোষ স্বীকার করলেই হয়ে গেল?’ এ পর্যায়ে এ্যাটর্নি জেনারেল আগে পুরো মামলার শুনানি নিতে অনুরোধ করেন। প্রধান বিচারপতি এ সময় বলেন, ‘একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আইন কমিশন আছে। সেখানে একজন নামকরা অধ্যাপক আছেন। তার লেখা ভাল অনেক বই আছে। অথচ আপনারা তাদের পরামর্শ নেন না। আইন তো চিন্তাভাবনা করে করতে হয়। মিনিস্ট্রি থেকে একজন লিখে দিল আর আইন হয়ে গেল? ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনবিদ, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আইন করা উচিত। সবাই মিলে আইন করলে সে আইনটা হয় গ্রহণযোগ্য।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা প্রকাশ্যে আদালতে অনেক কিছু বলি। এটাতে অনেক অপব্যাখ্যা হচ্ছে। বিচার বিভাগ সরকারের বিপক্ষে নয়। বিচার বিভাগ সব সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে রায় দেয়’। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এভাবে বললে হবে? এটার কি সলভ হবে? এগুলো বললে সংবাদপত্রে বড় বড় হেড লাইন হবে? তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাকে জানিয়ে দিলাম সমাধানের জন্য। উল্লেখ্য, হাইকোর্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করলে রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে গিয়েছিল গত সপ্তাহে। চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা ১৮ মে পর্যন্ত স্থগিত করে বিষয়টি আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলে রবিবার তা শুনানির জন্য ওঠে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম। এ্যাটর্নি জেনারেল রোজাসহ বিভিন্ন কারণে শুনানি ছয় সপ্তাহ পেছানোর আবেদন করলে আপীল বিভাগ ২ জুলাই শুনানির পরবর্তী তারিখ রাখে। আদেশে বলা হয়, ওইসময় পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত থাকবে এবং এর মধ্যে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপীল করতে হবে। তিনটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ ও ২০১২ সালে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১১ মে ওই রায় দেন। ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ১১টি ধারা-উপধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, এ আইন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা পারাপার বন্ধে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলামোটর মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে। ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা পারাপার বন্ধে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলামোটর মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত অধ্যাদেশ জারি করে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাস করে তা আইনে পরিণত করে। এরপর থেকে এটি ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন নামে পরিচিত। এ আইনের ৫ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনের ৬(১), ৬(২), ৬(৪), ৭, ৮(১), ৯ ও ১০ ধারায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পদ্ধতি, ১১ ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা ও ১৩ ধারায় আপীল সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। আর ১৫ ধারায় তফসিল সংশোধনে সরকারের ক্ষমতার বিধান রয়েছে। রায়ের সার-সংক্ষেপে হাইকোর্ট বলে, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের এসব ধারা মাসদার হোসেন মামলার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে সংবিধানের মৌলিক দুটি স্তম্ভ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী। তাই এ ধারাগুলোকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো।’
×