ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী মামলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ মে ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী মামলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপীল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষকে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ না দিতে বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা)। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, সাংবিধানিক বিষয়ে কথা বলতে গেলে বঙ্গবন্ধু আসবেই। রবিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় দিনের শুনানি শুরু হওয়ার আগেই এসব কথা হয়। শুনানি শেষে আজ সোমবার বেলা সাড়ে এগারোটায় ফের শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন হাইকোর্ট বাতিল করলে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও আইন সভায় উত্তাপ ছড়িয়েছিল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীলেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেলের। রবিবার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজাও ছিলেন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। যুক্তিতর্ক শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করেন বলেন, ‘এই মামলাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক মামলা। রাজনৈতিক বক্তব্য রাখবেন না। আমরা রাজনৈতিক বক্তব্য গ্রহণ করব না।’ তিনি আরও বলেন, আপনারা যে কথাই বলুন, কোর্টকে এ্যাড্রেস করে বলবেন। সাইট টক করবেন না। বিরূপ মন্তব্য করতে বাধ্য করবেন না। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এটা (সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) মার্শাল ল’র মাধ্যমে করা হয়েছিল। আপনারা যাদের এ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) করেছেন তাদের কেউ কেউ ওই সময় মার্শাল ল’ দ্বারা পরিচালিত সরকারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, জনাব এ্যাটর্নি জেনারেল, আপনার কাছ থেকে আমরা এই ধরনের বক্তব্য আশা করিনি। আমরা সব কিছু বিবেচনায় নিয়েই এ্যামিকাস কিউরিদের নিয়োগ দিয়েছি। যাদের সাংবিধানিক জ্ঞান আছে তাদেরই আমরা এ্যামিকাস কিউরি করেছি। আপনি যদি কাউকে চান তাকেও নিয়োগ দেয়া হবে। প্রধান বিচারপতি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে আরও বলেন, আপনারা ১০০ জনও যদি একপক্ষে মত দেন আর তা যদি কোর্টের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, আমরা সেই মতামত নেব না। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আমি এ কথা বলতাম না। তাদের (এ্যামিকাস কিউরি) লিখিত বক্তব্য দেখে আমার এমনটা মনে হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি রাজনৈতিক বিষয়ে বক্তব্য না রাখতে বলেছেন। তবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিষয়েও যদি কোন কথা বলতে হয় তাহলে বঙ্গবন্ধু ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ চলে আসবে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গও কি আনা যাবে না? জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, আসবে তবে রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম একটা গালি শুনেছি। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা তো সমাধান হয়ে গেছে। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না নিষ্পত্তি হয়নি, রক্তক্ষরণ হতেই থাকবে। রাজনৈতিক বক্তব্য না দেয়ার নির্দেশনা সংক্রান্ত আলোচনার পর অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। প্রথমদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত সোমবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে। শুনানি শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুরাদ রেজা বলেন, আজকে (রবিবার) আমার মূল বক্তব্য ছিল এই রিট পিটিশনটাই মেনটেনেবল (গ্রহণযোগ্য) নয়। এটি কোন অবস্থায়ই পাবলিক ইন্টারেস্টের (জনস্বার্থের) আওতায় পড়ে না। তিনি বলেন, এই কেসেও যদি কেউ এ্যাগ্রিভড (সংক্ষুব্ধ) মনে করেন, তাদের সঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের জাজরাও মনে করতে পারেন। কিন্তু বর্তমান মামলাটি কোনভাবেই পাবলিক ইন্টারেস্ট হতে পারে না, এটা ছিল আমার বক্তব্য। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ আপীল বিভাগের রায় খ-ন করেছে। হাইকোর্ট বিভাগ আপীল বিভাগের সমস্ত রায় মানতে বাধ্য। হাইকোর্ট বিভাগ এটি খর্ব করেছে। তিনি আরও বলেন, এছাড়া বলেছি এ মামলাটি প্রিম্যাচিউরড। এখানে একটি আইন পাস করার কথা ছিল, সেটিও করা হয়নি। উদাহরণ দিয়ে আমি বলেছি, যে শিশুটির জন্মই হয়নি সেই শিশুটিকে গলাটিপে মেরে ফেলার প্রয়াস চালানো হয়েছে এ মামলা করে। ষোড়শ সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সংশোধন এনে বলা হয়েছে, বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সংবিধান সংশোধনের পর অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে তৈরি একটি আইনের খসড়ায় মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিলেও হাইকোর্টের রায়ের পর তা ঝুলে যায়। অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধানের ৯৬ ধারাটি সংবিধান প্রণেতারা প্রথম থেকেই রেখেছেন। মাঝখানে মার্শাল ল’ অথরিটি বেআইনীভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রভিশন ঢুকিয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বরং আমরা সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গেছি। এতে সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের কোন পরিবর্তন হয়নি। মূল ধারায় ফিরে যাওয়া কোনভাবেই সাংঘর্ষিক হতে পারে না। হাইকোর্ট ডিভিশন একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েক আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ওই রায় আসে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে পেপার বুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এই মামলার আপীল শুনানি শুরু হয়। ৯ মে দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি হয়। এ দুদিন রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা হাইকোর্টের রায় আদালতে পড়ে শোনান। এর পর ওইদিনই আদালতে চার এ্যামিকাস কিউরি তাদের লিখিত মতামত জমা দেন। এই চারজন হলেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূইয়া। সেদিনই আদাল ২১ মে শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেছিল।
×