ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় যাত্রায় ভালবাসায় সিক্ত আবদুল্লাহ খালিদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ মে ২০১৭

বিদায় যাত্রায় ভালবাসায় সিক্ত আবদুল্লাহ  খালিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য স্মারক অপরাজেয় বাংলা নামের ভাস্কর্য গড়েছিলেন ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। বিদায় যাত্রায় সেই ভাস্কর্যের সামনেই সর্বসাধারণের ভালবাসায় সিক্ত হলেন এই শিল্পী। রবিবার দুপুরের তীব্র খরতাপ উপেক্ষা করে তাঁর শবদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। এর আগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আরেক শ্রদ্ধানুষ্ঠানে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান শিল্পী, চারুশিক্ষক ও চারুশিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বাদ যোহর জানাজা শেষে বিকেলে তার লাশ দাফন করা হয় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। আগামী ২৬ মে পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তাঁর জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। এদিকে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে শোক বার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন গুণী ও নিবেদিত প্রাণ ভাস্কর্য শিল্পীকে হারাল। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য দেশের মানুষ আজীবন স্মরণ করবে তাঁকে। শনিবার রাত পৌনে ১২টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। সকালে তার মরদেহ শেষবারের মতো নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রিন রোডের বাসভবনে। সেখান থেকে বেলা ১১টায় তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। সেখানে তার প্রতি চারুকলা অনুষদের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক শেখ আফজাল। এছাড়াও শ্রদ্ধা নিবেদন করে চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ, ছাপচিত্র বিভাগ, ভাস্কর্য বিভাগ, কারুশিল্প বিভাগ, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ, প্রাচ্যকলা বিভাগ, মৃৎশিল্প বিভাগ এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শিল্পী রফিকুন নবী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, নাট্যজন ম. হামিদ প্রমুখ। রফিকুন নবী বলেন, ১৯৬৪ সালে আমি যখন চারুকলা অনুষদে শিক্ষকতা শুরু করি, তখন আমার প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিল সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। আমার স্নেহের ছাত্রদের মধ্যে সে ছিল অন্যতম। অপরাজেয় বাংলার লে-আউটটি আমার কাছে নিয়ে এসেছিল, তখন আমি ভাস্কর্যে এতগুলো অবয়বের পক্ষে ছিলাম না। ভাস্কর্যটি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তৈরি করে দেখিয়ে দিল। এ বছর একুশে পদক পাওয়ার পর সে আমাকে বলেছিল, আমার কাজের স্পৃহা বেড়ে গিয়েছে। সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলেন, তার অপরাজেয় বাংলা অপূর্ব সুন্দর একটি ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের পর এমন একটি ভাস্কর্যের প্রয়োজন ছিল। এটির জন্য তাকে এ দেশের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে। সালেহ চৌধুরী বলেন, সে আমার মামাত ও খালাত ভাই। আমি ওকে চোখের সামনে বড় হতে দেখেছি। ও ভাস্কর্যটি তৈরি করে আমাকে দেখাতে নিয়ে যায় ও একটি নাম দেয়ার অনুরোধ করে। আমি ওর ভাস্কর্যটি দেখে ‘দৈনিক বাংলা’য় ‘সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের অনন্য সৃষ্টি : অপরাজেয় বাংলা’ শিরোনামে একটি কলাম লেখি। সেখান থেকেই এর নামকরণ হয়। একইভাবে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘অঙ্কুর’ ও চাঁদপুরে ‘অঙ্গীকার’ নামে আরেকটি ভাস্কর্যের নামকরণও আমি করি। ওর চলে যাওয়া এ দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’ ম. হামিদ বলেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি নির্মাণে মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাধা আসতে শুরু করে। কিন্তু সে সময় এটি নির্মাণ আমাদের জন্য একটি আন্দোলন ছিল। সে আন্দোলনে আমরা সব সময়ই উনাকে পেয়েছি সামনের সারিতে। তিনি কখনও মৌলবাদীদের কাছে মাথানত করেননি। এ সময় তিনি অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে যুক্তদের নামের একটি তালিকা সংবলিত একটি নামফলক করার দাবি জানান। চারুকলা অনুষদ থেকে আবদুল্লাহ খালিদের মরদেহ নিয়ে আসা হয় অপরাজেয় বাংলা পাদদেশে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় আয়োজন করা হয় নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠান। সেখানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগের পক্ষে সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শ্রদ্ধা জানান। আরও শ্রদ্ধা জানায় বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাবি শিক্ষক সমিতি, কবিতা পরিষদ, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, ছাত্রলীগ, এশিয়াটিক সোসাইটি, উদীচী, চারুশিল্পী সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান চিত্রশিল্পী হামিদুজ্জামান খান, মনিরুল ইসলাম, শহীদ কবির, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, কবি মুহাম্মদ সামাদ প্রমুখ। পরিবারের পক্ষে শিল্পীর স্ত্রী উম্মে কুলসুম বলেন, ‘আমি এখানে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি, অপরাজেয় বাংলা যতেœ থাকুক। এখানে ভাস্কর্যের কোন নামফলক। আমি এখানে নামফলক স্থাপনের দাবি জানাই। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতার পক্ষের সব আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি আমাদের পাশে ছিলেন। তিনি পোস্টার এঁকে সেগুলো মিছিলে নিয়ে আসতেন। তার গড়ে যাওয়া অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি এখনও আমাদের সব আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। তার এ চলে যাওয়া প্রত্যাশিত ছিল না। আমাদের দেশে ভাস্কর্য শিল্পটি তুলনামূলকভাবে কম চর্চা হয়। সব ভাস্কর্য ও শিল্পসম্মত নয়। সেখানে তিনি এ শিল্পকর্মের প্রতি অনুরক্ত থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, অপরাজেয় বাংলা তার অমর সৃষ্টি, যা তাকে সারাজীবন জীবিত রাখবে। এ ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছেন, তরুণ প্রজন্ম সে পথে চলবে। হামিদুজ্জামান খান বলেন, খালিদ অনেক জেদি প্রকৃতির ও সাহসী একজন মানুষ ছিলেন। সাহসিকতার সঙ্গে তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। ‘অপরাজেয় বাংলা’র কারণে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন। মনিরুল ইসলাম বলেন, সে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ছিল এবং তার স্ত্রী আমার ছাত্রী ছিল। তার সঙ্গে আমার এমনই পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। খালিদের ভেতরে একটা বারুদ ছিল। সে প্রচুর কাজ করেছে। তার মধ্যে অপরাজেয় বাংলাটি সেরা। এর একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। চবির ক্লাস সাসপেন্ড, শোক স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, অপরাজেয় বাংলার স্থপতি অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের প্রতি সম্মান জানিয়ে রবিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস সাসপেন্ড করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীন আখতার, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল হুদা এবং প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী। এক বিবৃতিতে তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। চবি উপাচার্য বলেন, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়। তিনি একজন গুণী শিক্ষক ছিলেন। শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শিল্পকলা পদক ও একুশে পদকে ভূষিত এ মহান শিল্পীর কালজয়ী শিল্পকর্ম এবং সৃষ্টি দেশ ও জাতির ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই গুণী শিক্ষক ও শিল্পীর মৃত্যুতে তার সম্মানার্থে রবিবার বেলা ১১টা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস সাসপেন্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের শোক ॥ ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ। প্রেসক্লাব সভাপতি কলিম সরওয়ার ও সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন। তারা বলেন, এই মৃত্যু শিল্প জগতে অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সম্বলিত টেরাকোটা ম্যুরাল স্থাপন করেন, যা বাংলাদেশের কোন প্রেসক্লাবের ইতিহাসে প্রথম। শিল্পকর্ম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×