ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেহেরপুরে মারা গেছে শতাধিক, আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ

আতঙ্কের নাম আর্সেনিক

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২২ মে ২০১৭

আতঙ্কের নাম আর্সেনিক

সংবাদদাতা, মেহেরপুর, ২১ মে ॥ জেলায় বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম আর্সেনিক। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় জেলার মানুষ জেনেশুনে বুঝেই এ বিষ পানি পান করে চলেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সদর উপজেলার আলমপুর, আমঝুপি, বেলতলাপাড়া, বুড়িপোতা, উজলপুর, সুবিদপুর, গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা, তেঁতুলবাড়িয়া, মুজিবনগর উপজলার, তারানগর, জয়পুর গ্রামে। এসব গ্রামের টিউবওয়েলের পানিতে ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় নিরুপায় হয়েই আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। নব্বই দশক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে বলে জানা গেছে। আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার মানুষগুলো বাঁচতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় আর্সেনিকোসিস রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭৯ জন। তবে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেছে বলে তাদের কাছে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, জেলায় আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে শতাধিক নারী-পুরুষ। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এখনও অনেকে আক্রান্ত হয়ে বিছানাগত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আর্সেনিক আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে কিছু কিছু রিং টিউবওয়েল, কয়েকটি এনজিও সংস্থা থেকে নিরাপদ পানির প্লান্ট স্থাপন করা হলেও তার বেশির ভাগ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আবার কোন কোনটি বিদ্যুত সংযোগ এবং সংস্কারের অভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ফলে নিরাপদ পানি না পেয়ে ভয়াবহ মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে এসব এলাকার নারী-পুরুষ। জনস্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে থেকে জানা গেছে, নব্বই দশকের আগে আর্সেনিক সম্পর্কে এ জেলার মানুষের তেমন কোন ধারণা ছিল না। কিছু কিছু মানুষের ত্বক খসখসে হওয়া, শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় চিকিৎসা করতে গিয়ে আর্সেনিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ টিউবওয়েলের ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে এসব টিউবওয়েলগুলো লাল রং করে দেয়া হয়েছে। মানবদেহের জন্য আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা .০৫ পিপিবি হলেও টিউবওয়েলগুলোতে ২শ’ থেকে ৩শ’ পিপিবি পর্যন্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এলাকাবাসী বলছে, মানুষ অনুপায় হয়ে ওই সব টিউবওয়েলের পানি পান করছে। জানা গেছে, গত ১০ বছরে মারা গেছে আলমপুর গ্রামের মৃত মহাসিনের ছেলে আলী হোসেন, খালেক হোসেন, মনি, পালু, পালুর ছোট ছেলে ইলিয়াস, মহাসিনের ভাই আব্দুর রাজ্জাক তার ছেলে মোজাফফর ও রকি, বোন রেনুফা, আওয়ালাদের ছেলে আসাদ ও রাজ্জাক এবং আসাদের স্ত্রী ঝুনু, কালামের স্ত্রী কফিরন নেছা, মেয়ে রেশমা খাতুন, উত্তরপাড়ার ইলাহী বক্স, আসাদ আলী, আসাদ আলীর ছেলে মিনারুল ইসলাম, কালাচাঁদ ম-লের ৬ ছেলে জহির হোসেন, ইকতার হোসেন, মুক্তার হোসেন ও রমজান আলী, রমজানের স্ত্রী আজেদা খাতুনসহ কমপক্ষে ২০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে মল্লিকের ছেলে আবুল হোসেন, পাচুর ছেলে জালার উদ্দীন, জহিরউদ্দীনের ছেলে আব্দুল হোসেন, পাচু ম-লের ছেলে জিব্রাইল হোসেন, ইসমাইল হোসেন, ছলিম উদ্দীন, রহেদ আলী ও সুখজানসহ শতাধিক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরেও অবস্থার পরির্বতন না হওয়ায় বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নিচ্ছেন কয়েক হাজার মানুষ। একই ধরনের অবস্থা আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকার মানুষের। গ্রামবাসীদের অনেকেই জানান, স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থা করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বিভাগও তেমন কোন পরামর্শ প্রদান করেন না। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকার ফলে চিকিৎসা করেও কোন লাভ হচ্ছে না। আলমপুর গ্রামের দক্ষিণপাড়ার গৃহবধূ রিনা খাতুন জানান, গ্রামবাসীরা আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়ায় পাশর্^বর্তী কোন গ্রামের মানুষ তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে চায় না। ইতোমধ্যে গ্রামের বেশ কয়েকটি বিয়েও ভেঙ্গে গেছে। বিয়ের পর কয়েকজন নববধূ বিষয়টি টের পেয়ে বাবার বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসেনি। গ্রামের মোমেনা বেগম সরকারের নিকট দাবি করে বলেন, আমরা এ দেশের নাগরিক। তাই সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আমাদেরও আছে। সরকার দ্রুত আমাদের জন্য সাপ্লাইয়ের পানির ব্যবস্থা করুক। না হলে গ্রামের সকলে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল কবির জানান, তাদের পল্লী পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে রিং টিউবওয়েল দিয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক সময়ে বিশ^ব্যাংকের সহযোগিতা ছিল কিন্তু এখন নেই। ট্রিটমেন্ট প্লান্টের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও এর আগে আমরা বিভিন্ন গ্রামে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের ব্যবস্থা করেছি। মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের সির্ভিল সার্জন গাজি খান মোহাম্মদ সামসুজ্জামান জানান, আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের লিস্ট করে তাদের মাঝে ওষুধ সরবারহ করা হয়। বিদেশী একটি সংস্থার সহযোগিতায় আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দেয়ার ফলে আমরা কাজ করতে পারছি না। তবে আমাদের নিকট যারা আসে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।
×