ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শহীদ কাদের

গণহত্যা জাদুঘর অগ্রযাত্রার তিন বছর

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২২ মে ২০১৭

গণহত্যা জাদুঘর  অগ্রযাত্রার তিন বছর

একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা, নির্যাতনকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার ব্রত নিয়ে আজ থেকে তিন বছর আগে খুলনা শহরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা জাদুঘর হিসেবে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের গণহত্যা, নির্যাতনের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে। প্রথমবারের মতো আমরা উদ্যোগ নিয়েছি দেশের প্রত্যেকটি বধ্যভূমির ওপর আলাদা গ্রন্থ প্রণয়নের। যেগুলোতে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও স্বজনহারাদের ভাষ্যে উঠে এসেছে একাত্তরের বর্বরতার ইতিহাস। আমরা সারা বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া বধ্যভূমিগুলোকে একত্র করতে উদ্যোগ নিয়েছি উপজেলাওয়ারি বধ্যভূমি জরিপের। আমাদের উদ্যোগে সারাদেশে হারিয়ে যাওয়া বধ্যভূমি, গণকবরগুলো সংরক্ষণ ও নামফলক লাগানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশের গ-ি পেরিয়ে আমরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানে নির্মাণ করেছি ভাস্কর্য উদ্যান। গত তিন বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি একাত্তরের গণহত্যার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের ঘোষণা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর পাশাপাশি আমরাও সবসময় রাজপথে ছিলাম গণহত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রশ্নে। এই ঘোষণা আমাদের কর্মকা-ে নতুন উৎসাহের সূচনা করেছে। আমরা এখন অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে চেষ্টা করছি একাত্তরে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের। গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘরের গুরুত্ব পেয়েছে গণহত্যা ও নির্যাতন। নির্যাতনের প্রকার ভেদ আছে, ১ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন, দেশ ত্যাগ করেছেন, অনেকে দেশের অভ্যন্তরে পালিয়ে বেরিয়েছেন, শরণার্থীদের মধ্যেও প্রচুর মানুষ মারা গেছেন। এসবই গণহত্যা-নির্যাতনের অংশ। আমরা জাদুঘরে সর্ব সাধারণের জন্য এসব ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই জাদুঘরের সঙ্গে গণহত্যা বিষয়ক একটি আর্কাইভও গড়ে তোলা হয়েছে। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি গবেষণা কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাদুঘরের উদ্যোগে বধ্যভূমি, গণকবর, চিহ্নিত করে ফলক লাগানো হচ্ছে, গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা প্রকাশিত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই জাদুঘরটি গড়ে তোলার জন্য এক টুকরো জমি ও বাড়ি বরাদ্দ করেছেন। দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহের ৬ দিন (সোমবার ব্যতীত) জাদুঘর উন্মুক্ত থাকে। গণহত্যায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে তৈরি করা হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি কক্ষ। যেখানে শহীদ ডাক্তার আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, সিরাজউদ্দিন আহমেদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজাম উদ্দিন আহমেদসহ অনেক দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিস্মারক সংরক্ষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোন অঞ্চলে এত কম সময়ে এত মানুষ হত্যা করা হয়নি। হয়েছিল বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যার সূচনা করে ঢাকায়। পরে সারাদেশে তারা ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তিকমিটির সদস্যরা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলাম প্রভৃতি দলের সদস্যরা এসব বাহিনী তৈরি করেছিল। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ রূপান্তরিত হয়েছিল আলবদর বাহিনীতে। রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী তারা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল এবং ২ লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছিল। সম্প্রতি গবেষকরা বলেছেন শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের ওপর এবং নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ৬ লাখের কাছাকাছি। জিয়াউর রহমান দেশীয় এই খুনীদের পুনর্বাসন করেছিলেন। দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর, যার পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনও করা সম্ভব হয়নি। নির্যাতনের শিকার বহু নারী-পুরুষ এখনও রোমহর্ষক স্মৃতি রোমন্থন করেন। সেসব গণহত্যার বৃত্তান্ত, বধ্যভূমি ও গণকবরের কথা, এমনি কী নির্যাতনের কথা বিজয়ের গৌরব-ভাষ্যে উপেক্ষিত থেকে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায়, অনুপুঙ্খ ইতিহাস অনুসন্ধানে এসবের গুরুত্ব অপরিসীম। গণহত্যা, বধ্যভূমি ও নির্যাতনের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং এ সংক্রান্ত সংগ্রহশালা তৈরি আমাদের জাতীয় কর্তব্য। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উঠে আসার পাশাপাশি উত্তরপ্রজন্মের মাঝে মুক্তি সংগ্রামের মর্মবাণী প্রতিভাত হবে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নানামুখী নির্যাতনের দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য উপকরণ সংগ্রহ এবং জাতির সামনে মুক্তিযুদ্ধের মর্মকথা তুলে ধরা। এর পাশাপাশি একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণমুক্ত ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমাজ নির্মাণের বাণী প্রচার করা এ প্রতিষ্ঠানের আদর্শ। ইতোমধ্যে খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি গণকবর নির্দিষ্টকরণ ও নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলে গত এক বছরে প্রায় ২০টি অচিহ্নিত গণকবর, বধ্যভূমি চিহ্নিত করে ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। যা শুধু দক্ষিণাঞ্চলে নয় সারাদেশে প্রশংসিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বই ও দলিলপত্র সংগ্রহের কাজ চলছে। লাইব্রেরি প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। (রবিবার ব্যতীত) আর্কাইভ থেকে আর্কাইভ বার্তা নামক নিয়মিত একটি বুলেটিন প্রকাশ করা হচ্ছে। আমাদের প্রস্তাবে ত্রিপুরা সরকার ও ত্রিপুরা জাতীয় জাদুঘরে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা’ শীর্ষক একটি গ্যালারি স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে ত্রিপুরার চোত্তাখোলায় ভারত সরকার নির্মিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানে আমরা একটি স্মারক ভাস্কর্য উদ্যান গড়ে তুলছি, যেখানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী, তেজস হালদার ও মাহমুদুল হাসানের ভাস্কর্যকর্ম স্থান পেয়েছে। প্রথমবারের মতো শিল্পী হাশেম খান একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন এই উদ্যানে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এর স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি। বিশিষ্ট শিল্পী, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হাশেম খান সহ-সভাপতি। ট্রাস্টি সম্পাদক ডাঃ শেখ বাহারুল আলম। ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে পুরোধা শাহরিয়ার কবির, জাতীয় কবিতা পরিষদের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কবি তারিক সুজাত, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রাজশাহীতে স্থাপিত আর্কাইভ ‘দি হেরিটেজের প্রতিষ্ঠাতা’ অধ্যাপক মাহবুবর রহমান, খুলনা প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আলমগীর। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নির্বাসিত জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে সূচিত হয় জিয়াউর রহমান কর্তৃক বন্দুকের জোরে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানী ধারার রাজনীতি পরির্বতনের সূচনা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আবার আশায় বুক বাঁধে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বিসর্জন দিয়েছিলেন। জাতির জনকের কন্যা স্বদেশে ফিরে ঘোষণা দিলেন, তিনি ফিরিয়ে আনবেন মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছেন বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিÑ বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণে রেখেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৭ মে। আমাদের মূল দর্শন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণ ও বিকাশ। আমরা চাই এই জাদুঘর ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে একটি সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করতে। এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম প্রতিষ্ঠান এটি। দেশের সবচেয়ে বেশি গণহত্যা ও নির্যাতন ঘটেছে এই অঞ্চলে। সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি চুকনগরের অবস্থান এখানে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমরা গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক জোন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি, যেখানে এসে আগামী প্রজন্ম তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান পাবে। আজ আমাদের এই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শুভ হোক আর্কাইভ ও জাদুঘরের অগ্রযাত্রা। লেখক : ট্রাস্টি, ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট
×