ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুত্র-জামাইর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিপর্যস্ত আওয়ামী রাজনীতি

ভূমিমন্ত্রীর গৃহবিবাদে সৃষ্ট নৈরাজ্যে ঈশ্বরদী টালমাটাল

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২১ মে ২০১৭

ভূমিমন্ত্রীর গৃহবিবাদে সৃষ্ট নৈরাজ্যে ঈশ্বরদী টালমাটাল

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ২০ মে ॥ কোন রাজনৈতিক বিরোধ ছাড়াই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত পাবনার ঈশ্বরদীতে শুধুমাত্র ভূমিমন্ত্রীর পুত্র-জামাইয়ের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ভূমিমন্ত্রীর গৃহবিবাদে সৃষ্ট নৈরাজ্যে ঈশ্বরদীতে দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। তবে এ বিরোধ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের নয়। বিরোধ মূলত জামাই-শ্বশুরে। প্রায় প্রতিদিনই এ দুটি গ্রুপের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদে ঈশ্বরদী এখন আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে। মূলত ভূমিমন্ত্রীর গৃহবিবাদে ঈশ্বরদীর পরিবেশ এখন অস্থিতিশীল, ঘটছে হামলা-ভাংচুর, চাঁদাবাজিসহ হত্যার মতো ঘটনাও। জামাই না শ্বশুর- কে বেশি ক্ষমতাধর, এলাকায় তার মহড়া চলছে। উভয়পক্ষই প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন, হামলা-ভাংচুরসহ নানাভাবে পেশীশক্তির ব্যবহার করছে। আধিপত্য বিস্তারের কারণ হিসেবে আগামী সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া উপজেলা) আসন থেকে দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়েই মূলত জামাই-শ্বশুরের দ্বন্দ্ব শুরু। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর জামাতা ও ঈশ্বরদীর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু চান শ্বশুরের জায়গায় স্থান পেতে। অন্যদিকে মিন্টুর স্ত্রী ভূমিমন্ত্রীর মেয়ে মেহজাবিন শিরিন পিয়াও নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার পক্ষে রয়েছেন স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ, মেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহজাবিন শিরিন পিয়া, ছেলে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিরহান শরীফ তমাল ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব সরকার, ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান মিন্টু, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মন্ত্রীর এপিএস বশির আহমেদ বকুল। অন্যদিকে জামাই পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঈশ্বরদীর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টুর পক্ষে রয়েছেন ঈশ্বরদী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস, শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা রশিদুল্লা, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাস, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাম খানসহ স্থানীয় ঠিকাদারদের বড় একটি অংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দলীয় নেতাকর্মী জানান, এক সময় ঈশ্বরদীতে একক আধিপত্য ছিল মন্ত্রীর জামাতা মিন্টুর। তার কথায়ই সবকিছু হতো। ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে মিন্টুর নানা নির্দেশ পালন করতেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম খান ও ছাত্রলীগ সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাস। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায়, সাংসদ ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমানের কথাও ওই তিনজন অমান্য করতে শুরু করেন। এরই মধ্যে গত বছরের ২৫ জুন যুবায়েরের গুলিতে তার স্ত্রী গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় দীর্ঘদিন এ ছাত্রলীগ নেতা আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। এরপর মিন্টুর নির্দেশে আরও একটি আলোচিত ঘটনার জন্ম দেন সালাম খান ও যুবায়ের। তাদের নেতৃত্বে গত বছরের ১০ আগস্ট ঈশ্বরদীতে মন্ত্রী-সমর্থকদের জঙ্গীবিরোধী মিছিলে গুলি ও হামলা চালানো হয়। ওই সময় থেকেই মূলত জামাই-শ্বশুরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। সালাম খান ও যুবায়ের বিশ্বাসকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন মন্ত্রী। এরপরই মিন্টু কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এতে তাদের পদ্মা নদীর বালুমহাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজসহ বিভিন্ন দফতরের ঠিকাদারি হাতছাড়া হয়ে যায়। অপরদিক ঠিকাদারি ও কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মন্ত্রী বিকেএসপিতে অধ্যয়নরত ছেলে শিরহান শরীফ তমালকে ঈশ্বরদী নিয়ে আসেন। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তমাল সপ্তম। গত বছরের ১৯ নবেম্বর বাবার দৌলতে উপজেলা যুবলীগের সভাপতির পদ পান তিনি। একই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক করা হয় রাজীব সরকারকে। পদ পাওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তমাল। রাজীব সরকারের সার্বক্ষণিক পরামর্শে উপজেলার সব প্রতিষ্ঠানে তিনি হস্তক্ষেপ শুরু করেন। দীর্ঘদিন নীরব থাকা মন্ত্রীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ ছেলে তমাল ও ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান মিন্টুকে দিয়ে এলাকায় আবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। ভূমিমন্ত্রী তার আধিপত্য ধরে রাখতেই তমালকে রাজনীতির মাঠে নামিয়েছেন। জামাই না শ্বশুর- কে বেশি ক্ষমতাধর এলাকায় তার প্রদর্শন চলছে। উভয়পক্ষই হামলা-ভাংচুর, প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন ও নানাভাবে পেশীশক্তির ব্যবহার করছে। ইতোমধ্যেই তমাল গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। তাদের অপরাধমূলক কর্মকা-ে অসহায় দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ, ভয়-আতঙ্কও নিত্যসঙ্গী ঈশ্বরদীবাসীর। পরিস্থিতি এটতাই ভয়াবহ যে, ভূমিমন্ত্রীর ছেলের ‘ইশারা’ ছাড়া ঈশ্বরদীতে কোন কাজই হয় না। দখল-আধিপত্য-চাঁদাবাজিতে এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, জামাই-শ্বশুরের কোন্দলে ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিও বিপর্যপ্ত হয়ে পড়েছে। পাবনা জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে মন্ত্রীর ঠা-া বিরোধ তৈরি হয়। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি রেজাউল রহিম লালের বিপরীতে প্রার্থী হন মন্ত্রীর মেয়ে মেহজাবিন শিরিন পিয়া। সে সময় জেলা আওয়ামী লীগের একটি দল ঢাকায় মন্ত্রীর বাসায় দেখা করে তার মেয়েকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানায়। তবে মন্ত্রী এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন, যেহেতু এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তাই যে কেউ প্রার্থী হতে পারেন। আমি কাউকে নিষেধ করতে পারব না। নির্বাচনে মন্ত্রীর মেয়ের ভরাডুবি ঘটে। ভূমিমন্ত্রী ডিলুর মেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহজাবিন শিরিন পিয়া জানান, আমরা চাইব আমার বাবা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাক। বয়সের কারণে তিনি যদি মনোনয়ন না পান, তবে আমি মনোনয়ন চাইব। এদিকে পৌর মেয়রের সমর্থকদের প্রত্যাশা, মিন্টু দীর্ঘদিন তৃণমূলের রাজনীতি করছেন। তিনি মন্ত্রীর জামাই, তাই আগামীতে মন্ত্রীর উত্তরাধিকারী মিন্টুই। এ বিষয়ে পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টু জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের সময় অন্যায়কারীদের স্থান নেই। ঈশ্বরদীতে অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। বৃহস্পতিবারের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত যুবায়ের বিশ্বাস বলেন, ঈশ্বরদীতে তমাল ও রাজীব সরকারের নেতৃত্বে নানা অপকর্ম হচ্ছে। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ কোন কথা বলতে পারেন না। ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মোবাইলে ফোন করা হলে তার ছেলে তাকিবুর রহমান শরীফ ফোনটি রিসিভ করে বলেন, বাবা অসুস্থ, বিশ্রামে আছেন। পরে কথা বলবেন। পরে একাধিকবার ফোন করেও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল রহিম লাল জানান, সভাপতি নিজের এলাকায় দলের স্বার্থ না দেখে নিজের পরিবারের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। কে নেতৃত্বে আসবে, পরিবারে নেতৃত্ব থাকবে কি-না তার সিদ্ধান্ত নেয়া কোন রাজনৈতিক নেতার কাজ নয়। ঈশ্বরদীর বর্তমান অবস্থায় দলের চরম ক্ষতি হচ্ছে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দিনের আলোয় মুখে কালো কাপড় বেঁধে ভূমিমন্ত্রী জামাতা ও ঈশ্বরদীর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ মিন্টুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চালানো হয় সশস্ত্র হামলা। হামলার নেতৃত্ব দেন আবার ভূমিমন্ত্রীরই ছেলে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শিরহান শরীফ তমাল ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব সরকার। একই সময়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দোকানে হামলার পাশাপাশি মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি যুবায়ের বিশ্বাসের বাড়িতেও ভাংচুর চালানো হয়। রাতেই মামলা করেন যুবায়েরের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার বিশ্বাস। কিছু সময় পরই মন্ত্রীর বাড়িতে অভিযানে যায় পুলিশ। শুক্রবার ভোরের দিকে ভূমিমন্ত্রীর ‘ক্ষমতাধর’ ছেলেসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালত তাদের কারাগারে পাঠায়।
×