ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে দৈনিক কোটি টাকা চাঁদাবাজি

অবৈধ বার ক্লাবে অসামাজিক তৎপরতা ওপেন সিক্রেট

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২১ মে ২০১৭

অবৈধ বার ক্লাবে অসামাজিক তৎপরতা ওপেন সিক্রেট

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানী ঢাকায় পরিবারের ধনাঢ্য সন্তানদের বিনোদনের জন্য ১০২টি বার আছে, যার মধ্যে অর্ধেকই অবৈধ। এছাড়া তাদের জুয়া খেলার জন্য আছে নামীদামী ক্লাব। এসব বার ও ক্লাবে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর ঘটনা ওপেন সিক্রেট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ অসৎ শ্রেণীর সদস্যদের ম্যানেজ করেই এ ধরনের কার্যকলাপ চলে আসছে। এ জন্য প্রায় প্রতিদিনই কোটি টাকার চাঁদাবাজি লেনদেনের হাতবদল হচ্ছে। রাজধানীর বনানীতে দি রেইন ট্রি আবাসিক হোটেলেও অবৈধ বার তৈরি করে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর রাজধানীর হোটেলের বার, ক্লাবগুলোতে কি হচ্ছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীর ধর্ষণের ঘটনায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ধর্ষণকারীদের আইনের আওতায় আনার আগে পর্যন্ত সেখানকার ঘটনা কি কেউ জানতে পারত? বহুল আলোচিত এ জঘন্য ঘটনার খবর ফাঁস না হলে আপন জুয়েলার্সের মালিক যেমন সোনার ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যেত। তার ধর্ষক অভিযুক্ত ছেলেও অসামাজিক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখত। আর দি রেইন ট্রি হোটেলেও অবৈধ মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর ঘটনা চলমান থাকত। আপন জুয়েলার্সের মালিক ও তার ছেলে বিরুদ্ধে মামলা এবং দি রেইন ট্রি হোটেলের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা করা হয়েছে, যা এখন তদন্তনাধীন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ ও অসৎ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে রাজধানীতে আরও অনেক স্থানেই এ ধরনের অবৈধ ব্যবসার প্রসার ঘটেছে বলে অভিযোগের তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে ১০২টি বার রয়েছে, যার মধ্যে ৫২টি বার সরকারের অনুমোদিত। এর পাশাপাশি অলিখিতভাবে অনুমোদন ছাড়াই আরও অন্তত ৫০টি বার তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এক সময় রাজধানীতে পুলিশের অবৈধ আয়ের বড় উৎস ছিল মাদক স্পট। কিন্তু বিগত ৫ বছরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মাদক স্পটের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কারণে স্পটগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে গেছে। ঐসব স্পটে স্থানীয় থানা-পুলিশের সঙ্গে উঠতি রাজনৈতিক নেতারা চাঁদাবাজি করেন। এ কারণে পুলিশের অবৈধ আয়ের দৃষ্টি এখন বারগুলোর দিকে। একেকটি বার থেকে স্থানীয় থানা-পুলিশ মাসোহার পায়, যার মধ্যে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি হয়। অবস্থাভেদে এ চাঁদার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। রাজধানীর ফাইভ স্টার ও ফোর স্টার হোটেলগুলোতে সরকার অনুমোদিত বারগুলোতে তেমন চাঁদাবাজির কোন অভিযোগ নেই। হোটেলগুলোর বাইরে পৃথকভাবে গড়ে ওঠা বারগুলোতে চাঁদাবাজি হয়। এদের মধ্যে পরীবাগে ২টি, বাংলামোটরে ২টি, মগবাজারে ১টি, কাকরাইলে ৩টি, গুলশানে ৩টি ও তেজগাঁও এলাকায় ১টি বারে সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিতে হয়। রাজধানীর একাধিক বারের মালিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘সবই তো বুঝেন, চাঁদা না দিলে তো ব্যবসা করতে দেবে না। তার ওপর আছে বিভিন্ন প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদার হুমকি। ফ্রি খাওয়াতেও হয় অনেককে। এ কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় থানা-পুলিশকে বেশি ম্যানেজ করতে হয়। বৈধ ব্যবসা চালাতে গেলেই যেখানে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা চালানো যায় না সেখান বার ও ক্লাবে মদের ব্যবসার জন্য চাঁদা গুনতেই হবে’। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট সার্কেলের পরিদর্শকদের মাসে ১০ লাখ টাকা, স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ উঠতি নামধারী মাস্তান নেতাদের মাসে ৫ লাখ টাকা, সংশ্লিষ্ট ডিবি পুলিশের টিমকে ৫ লাখ টাকা, স্থানীয় থানা-পুলিশকে ৫ লাখ টাকা ছাড়াও পুলিশের বিশেষ শাখাসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাকে অবস্থা ভেদে কয়েক লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর ১৫টি ক্লাবে ইনডোর গেমসের নামে ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, চরকি রেমিসহ নানা নামের জুয়ার আসর বসে। রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ, পল্টন, রমনা, ফকিরাপুল, গুলশান, মিরপুর ও উত্তরা কেন্দ্রিক এসব ক্লাবের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রাত যত গভীর হয় জুয়ার আসর তত জমজমাট হতে থাকে। এ ক্লাবগুলোতে জুয়ার আসর বসাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশকে একটি মাসোহারা দিতে হয়। জুয়ার আসরে সংখ্যা অনুযায়ী মাসোহারার পরিমাণ ঠিক হয়। পুলিশকে এসব জুয়ার আসরে যেতে হয় না। নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট থানার ওসির কাছে চাঁদার টাকা পাঠিয়ে দেন। মতিঝিল কেন্দ্রিক একটি ক্লাবের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিমাসে থানাকে ২ লাখ টাকা দিতে হয়। এর পাশাপাশি প্রতি রাতে টহল পুলিশকে খুশি রাখতেও তাদের হাত খরচ দেয়া হয়। এর বাইরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সার্কেল কর্মকর্তাদেরও খুশি রাখতে হয়। বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন (১৮৬৭ সালে প্রণীত) অনুযায়ী, যে কোন ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোন সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারেন। এ রকম কোন ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যে কোন সরঞ্জামসহ কোন ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত (জুয়ারত) বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদ- অথবা ১০০ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারেন। পুলিশ জুয়ারসামগ্রীর খোঁজে যে কোন সময় (বল প্রয়োগ করে হলেও) তল্লাশি চালাতে পারবে বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে। কিন্ত এ আইন কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই প্রবাদের মতোই। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর অভিজাত এলাকার বার ও ক্লাবগুলোতে প্রতিদিনই কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও পিছিয়ে নেই। সংশ্লিষ্ট এলাকার ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী মাস্তানরা এসব ক্লাব ও বার থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি বার ও ক্লাবগুলোতে মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবহার প্রতিরোধে নিয়োজিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এসব বার ও ক্লাবে অভিজাত পরিবারের ধনীর দুলাল-দুলারীই বিনোদনের জন্য গিয়ে থাকেন, যা অভিভাবকদেরও অজানা নয়। রাজধানীর বনানীর দি রেইন ট্রি হোটেলে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদের মদ্যপান, অসামাজিক কার্যকলাপের আগে রাজধানীতে আরও অনেক অঘটন ঘটেছে। এর মধ্যে গত ১৮ এপ্রিল কচুক্ষেতের নিউ ওয়েভ ক্লাবে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনসহ ১১ সদস্য মিলিটারি পুলিশের হাতে আটক হয়। ডিবির পূর্ব বিভাগের অস্ত্র উদ্ধারকারী টিমের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনের নেতৃত্বে ১১ সদস্য তাদের অভিযানের আচরণবিধিও লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগের তদন্ত হয়। নিউ ওয়েভ ক্লাব ডিবির পশ্চিম বিভাগের মধ্যে পড়লেও পূর্ব বিভাগের অস্ত্র উদ্ধারকারী টিম অভিযান চালানোর সময় ডিবির কোন উচ্চপদের কর্মকর্তার অনুমতিও নেয়নি। এর পাশাপাশি কাফরুল থানা-পুলিশও ওই ক্লাব থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। চাঁদাবাজির ঘটনায় গঠিত পুলিশের তদন্ত কমিটি এমনই রিপোর্ট পুলিশ কমিশনারের কাছে দিয়েছে। নিউ ওয়েভ ক্লাবের সভাপতি শফিউল আজম এ ঘটনার পর বলেছেন, এ ক্লাবে লোকজন বিলিয়ার্ড খেলে, কেউ কেউ জিম করতে যান। এখানে ‘অবৈধ কিছু হয় না’। কচুক্ষেতের নিউ ওয়েভ ক্লাবে চাঁদাবাজি ঘটনার ৫ দিনের মাথায় গত ২৩ এপ্রিল পরীবাগে পর্যটন কর্পোরেশন পরিচালিত সাকুরা বারে চাঁদাবাজির অভিযোগে যুবদল নেতা জনি ওরফে বাবা জনিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে বারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পুলিশ বলছে, সাকুরা বার কর্তৃপক্ষ মাস্তানদের চাঁদা দিতে অতিষ্ট হয়ে গেছে। এরই জের ধরে জনি চাঁদাবাজি করার সময় প্রতিবাদ করলে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। ক্লাব ও বারগুলোতে অনেক অপরাধী তাদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পরিকল্পনা করার অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে রাজধানীর ৪৯ থানার পুলিশের চাঁদাবাজি ও অপরাধী কার্যক্রম বন্ধে শুরু করা হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। পুলিশ সদস্যরা যাতে মাদক, চাঁদাবাজি, অবৈধ লেনদেন, সন্ত্রাসসহ কোন ধরনের অপরাধে জড়াতে না পারেন সে জন্য গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করা হয়েছে। গোপনে চলা এ ধরনের গোয়েন্দা নজরদারির ফলে পুলিশ সদস্যদের কেউ বড় ধরনের অপরাধে জড়ানোর আগেই তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে পুলিশের মাঝে অপরাধ প্রবণতা কমে আসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষজনের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট থাকাতে সহায়তা করবে। রাজধানী ৪৯ থানা এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণাসহ নানা ধরনের অভিযোগ আসছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মোঃ মাসুদুর রহমান বলেছেন, অপরাধী যেই হোক না কেন, তা যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও হয় তাহলেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। কোন এক ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার তার প্রতিষ্ঠান বহন করবে না।
×