ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জামদানি বুনন প্রদর্শনী

সূক্ষ্ম সুতায় শিল্পিত সুন্দর, গৌরবের উত্তরাধিকার

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২১ মে ২০১৭

সূক্ষ্ম সুতায় শিল্পিত সুন্দর, গৌরবের উত্তরাধিকার

মোরসালিন মিজান ॥ জামদানি বোনা হচ্ছে। চোখের সামনে। দৃশ্যটি আগেও অনেকে দেখেছেন। তবুও কৌতূহল। বিস্ময় নিয়ে তাকানো। ভীষণ সুন্দরের গভীরে যাওয়ার এ চেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। সরকারী প্রতিষ্ঠানের গ্যালারিতে অনেক আগেই স্থান নিয়েছে জামদানি। সেখানে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার লবিতে স্থাপন করা হয়েছে একটি অস্থায়ী তাঁত। সেখানে কাজ করছেন রূপগঞ্জের বিখ্যাত দুই শিল্পী সবুজ মিয়া ও আমিনুল হক। দুই ভাইয়ের ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুনন শিল্প প্রদর্শনী দেখার পাশাপাশি রাখা হয়েছে কেনার সুযোগ। প্রাচীন বাংলার শ্রেষ্ঠ ধন মসলিন। বিস্ময়কর সৃষ্টি সম্পর্কে অবগত আছে সারা দুনিয়া। শুরু থেকেই পৃথিবী বিখ্যাত। কিন্তু এখন আর হয় না। তবে সেই গৌরবের উত্তরাধিকার হয়ে টিকে আছে জামদানি। আহা, কী সুন্দর কাজ! কত না যতেœ গড়া! দেখলে বাঙালী হিসেবে গর্ব হয়। বিদেশী বস্ত্র গায়ে জড়িয়ে যারা খুব আত্মতৃপ্তি বোধ করেন, অভিজাত ভাবেন নিজেকে, তাদের রুচির দুর্ভিক্ষ প্রমাণ করতে অতি সাধারণমানের একটি জামদানি-ই যথেষ্ট। আর যদি সবুজ মিয়া ও আমিনুল হকের তৈরি জামদানি হয় তাহলে তো কথাই নেই। জামদানি শিল্পের এ দুই শিল্পীকে বিশেষ জ্ঞান করেন গবেষকরা। একই চিন্তা থেকে ভ্রাতৃদ্বয়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছে জাতীয় জাদুঘর। আয়োজন করেছে জামদানি বুনন শিল্প প্রদর্শনীর। গত বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া প্রদর্শনী বিপুল আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করছেন উন্নত রুচির শৌখিন মানুষ। শনিবার জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, তাঁতে বসে নিজস্ব ভঙ্গিতে কাজ করছেন শিল্পীরা। একটি শাড়ির কাজ দুজনে মিলে করছেন। তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে ধরেছে কৌতূহলী চোখ। আগ্রহ নিয়ে কাজ দেখছেন দর্শনার্থীরা। যারপরনাই সূক্ষ্ম আর শিল্পিত বুনন। কাছ থেকে দেখার একটা আনন্দ আছে বৈকি! তবে সাদা চোখে খুব কিছু বোঝা যায় না। প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। সে অনুযায়ী সবুজ ও আমিনুল বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন। হাতে কাজ করে দেখাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রথম দিন বৃহস্পতিবার থেকে একটি শাড়ি বুনছেন তারা। জামদানির জন্য তিন দিন খুব সামান্য সময়। তবুও প্রশ্নÑ এ সময়ের মধ্যে কতটা হলো? বিভিন্ন নক্সা দেখা যাচ্ছে শাড়িতে। এগুলোর উৎস কী? জবাবে আমিনুল বলেন, জামদানি একটু একটু করে গড়ে নিতে হয়। এখন পর্যন্ত চার হাতের মতো বোনা সম্ভব হয়েছে। এখানে প্রদর্শনী হচ্ছে। তাই অল্প সময়ের মধ্যে কিছু কাজ করে দেখানোর চেষ্টা করছি আমরা। বেশি কাজের শাড়ি করছি না। আরও একটু ব্যাখ্যা করে তারা বললেন, প্রথম দেড় হাত গুঁড়ি। গুঁড়ির অংশটা কোমরে প্যাঁচ দিয়ে রাখা হয়। তাই সেখানে কোন নক্সা করা হয় না। দৃশ্যমান অংশেও হালকা কাজ কাজ করা হচ্ছে। এ কারণে কিছুটা দ্রুত হচ্ছে এই শাড়ির কাজ। জমিনের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট নক্সা করা হচ্ছে। একটি নক্সা দেখিয়ে সবুজ বললেন, এটি ‘চালছিটা ডিজাইন।’ ভাল করে লক্ষ্য করে দেখা গেল, চালের মোটিফ নিয়ে কাজ করেছেন শিল্পী। ভাতের চাল ছিটিয়ে দিলে যেমন দেখায়, ডিজাইনটা তেমনই দেখাচ্ছিল। শাড়ির পাড়ে আবার অন্য ডিজাইন। দুই ভাই জানলেন, এটির নাম ‘মদনপাইড়।’ এখানে আঙ্গুল, করলা, লাঙ্গল ইত্যাদি থেকে মোটিফ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। সবুজ জানান, বেশি কারুকাজ থাকলে একটি শাড়ি তৈরিতে দুই থেকে তিন মাস সময় লেগে যায়। যত বেশি কাউন্টের শাড়ি তত বেশি সূক্ষ্ম ও ঘন কাজ। সাধারণ জামদানি তৈরি করা হয় ৬০ থেকে ৮০ কাউন্টে। আর খুব মিহি কাজ হয় ১০০ কাউন্টের জামদানিতে। পেছনের দিকে আরও বেশকিছু শাড়ি প্রদর্শিত হচ্ছিল। একটি দেখিয়ে আমিনুল বললেন, এটি কাশফুল ডিজাইন। পাশের আরেকটি শাড়িতে সন্দেশ ফুল। এমন আরও কিছু ফুল, লতাপাতার নক্সা দৃশ্যমান করা হয়েছে শাড়িতে। নানা রং ও নক্সা করা জামদানি। শুধু তাকিয়ে দেখলেও মন ভরে যায়। একটি জামদানির খুব মিষ্টি রং। কাঁচা কলাপাতার রঙের সঙ্গে মিলে যায়। ইঞ্চিপাড় শাড়ির জমিনে বৃক্ষের ঘন নক্সা। দাম ৪০ হাজার টাকা। পাশেরটি বিস্কুট রঙের। জমিনে করাতের দাঁতের মতো নক্সা করা। কারিগরদের ভাষায়, ‘করাত ডিজাইন’। দাম ৩০ হাজার টাক। একটির জমিনে জুঁই তেরছি নক্সা। খুব ট্রাডিশনাল নকশাগুলোও আছে। পাশাপাশি কিছু শাড়িতে সাম্প্রতিক প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ। এখন চিকনপাড় শাড়ি বেশি চলে। নীল রঙের একটি জামদানির ভাঁজ খুলে দেখা গেল, মানানসই চিকন পাড়। এভাবে প্রতিটি শাড়িই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যের আধার। প্রদর্শনীতে শাড়ি ছাড়াও আছে মেয়েদের থ্রিপিস। ফতুয়া। ছেলেদের জন্য আছে পাঞ্জাবি। কুশন কাভার ইত্যাদিও করা হয়েছে। এভাবে দারুণভাবে সামনে এসেছে জামদানি। দীর্ঘদিন ধরে এ সৌন্দর্যের চর্চা করছেন সবুজ ও আমিনুল ভ্রাতৃদ্বয়। তারা জানান, দশ বছর বয়স থেকে জামদানির কাজ করেন। চাচা নূর হোসেনের কাছে হাতেখড়ি। যত দিন গেছে দক্ষতা বাড়ানোর আন্তরিক চেষ্টা করেছেন। ১৯৯১ সালের দিকে নিজেরাই তাঁত বসিয়ে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তাদের কাজের প্রশংসা সর্বত্র। আসছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। জাতীয় জাদুঘরের মূল গ্যালারিতে স্থায়ীভাবে যে জামদানি প্রদর্শিত হচ্ছে সেখানে স্থান পেয়েছে তাদের তৈরি জামদানি। জাতীয় পুরস্কারও লাভ করেছেন দুই ভাই। সরকারী উদ্যোগে বিদেশে গেছেন একাধিকবার। জাপান ও নেপালে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে তাদের জামদানি। এখানেই শেষ নয়। আমিনুল খুব গর্ব করে বলেন, আমাদের তৈরি জামদানি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পছন্দ করে কিনেছেন। পরেছেন। এরচেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কী হতে পারে? জাদুঘরে আসা দর্শনার্থীরা প্রতিদিনই বিপুল কৌতূহল নিয়ে জামদানির কাজ প্রত্যক্ষ করছেন। সবার চোখের সামনে তৈরি হচ্ছে শাড়ি। সীমা রায় নামের এক তরুণী একটির পর একটি প্রশ্ন করছিলেন। এটা-ওটা জানার চেষ্টা করছিলেন। পরে কানাডা প্রবাসী তরুণী জনকণ্ঠকে বললেন, জামদানির সৌন্দর্য তো সব সময় দেখছি। দেশে এলেই কিনে নিয়ে যাই। এবার কিভাবে বোনা হয়, সেটাও দেখলাম। এত সূক্ষ্ম কাজ এত সহজে কথা বলতে বলতে শিল্পীরা করছিলেন দেখে অবাক হয়ে গেছেন বলে জানান তিনি। প্রদর্শনী উপভোগের পাশাপাশি পছন্দের জামদানি কেনার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন শৌখিন মানুষ। যশোর থেকে সপরিবারে জাদুঘর পরিদর্শনে এসেছিলেন আবু ইউসুফ। বললেন, এই একটি জিনিস আমাদের, যেটা নিয়ে গর্ব করতে পারি। আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে জামদানি খুব যতœ করে পরে। তাদের জন্য তিনটি শাড়ি ও আমার নিজের জন্য একটি পাঞ্জাবি কিনলাম। জামদানি বুনন প্রদর্শনী এক সপ্তাহের মতো চলবে বলে জানিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
×