ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন ভ্যাট আইনে পণ্যমূল্য বাড়বে না ॥ এনবিআর

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ মে ২০১৭

নতুন ভ্যাট আইনে পণ্যমূল্য বাড়বে না ॥ এনবিআর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ নতুন ভ্যাট আইনে পণ্যমূল্য বাড়বে না বলে আশ্বস্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। অনলাইনে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের প্রাক্কালে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কৃষি ও জরুরী ওষুধ পণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নতুন ভ্যাট আইনের আওতার বাইরে রয়েছে। ফলে আগামী জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না। নির্মাণ সামগ্রীর মতো দু’একটি পণ্যের দাম কিছুটা বাড়লেও সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির কোন শঙ্কা নেই। তবে নতুন ভ্যাট আইনের দোহাই দিয়ে কেউ যাতে পণ্যমূল্য বাড়াতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তারা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তারা শনিবার মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক আইন ২০১২ নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজনেস এডিটরদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে ভোক্তাদের ওপর করের বোঝা কমবে। বর্তমানে ভোক্তারা যেখানে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদান করছেন, সেখানে নতুন আইনে তাদের ভ্যাট প্রদানের কার্যকর হার হবে ১৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। তবে নতুন আইনে ভ্যাটের হার কত হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আগামী ১ জুন ভ্যাটের চূড়ান্ত হার অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতার মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাবেন। কর্মকর্তারা জানান, নতুন ভ্যাট আইনে ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। কারণ এই আইনে ব্যবসায়ীদের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। অতীতে ভ্যাট কর্মকর্তারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতেন। কিন্তু নতুন আইনে সেই সুযোগ নেই। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য সংযোজন করে তার ওপর ভ্যাট আরোপ করবেন। তবে এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে। নতুন আইনে ভ্যাট সংক্রান্ত সকল কাজ অনলাইনে হবে। এক্ষেত্রে অতীতের মতো একাধিক রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন নেই। একটি কোম্পানি একটি রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমেই ভ্যাট সংক্রান্ত সকল কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে করদাতাকে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন পেতে, রিটার্ন দাখিল করতে কিংবা ভ্যাট রিফান্ড পেতে ভ্যাট কর্মকর্তাদের কাছে যেতে হবে না। সকল কাজ অনলাইনে করা হবে। ভ্যাট রিফান্ডের ক্ষেত্রে অতীতের মতো ব্যবসায়ীদের মাসের পর মাস ঘুরতে হবে না, ৬০ দিনের মধ্যে ভ্যাট রিফান্ডের অর্থ করদাতার ব্যাংক হিসাবে চলে যাবে। তবে ব্যবসা করতে হলে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে। ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন ছাড়া ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এই নতুন ভ্যাট আইন থেকে অব্যাহতি পাবেন। তবে ৩১ লাখ টাকা থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনকারী ব্যবসায়ীদের ভ্যাট হার কত হবে তা অর্থমন্ত্রী নির্ধারণ করে ১ জুন জানাবেন। কর্মকর্তারা আরও জানান, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের জন্য ব্যবসায়ীদের রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে রিটার্ন দাখিল, রিফান্ডের জন্য আবেদন- সব বিষয়ে সহায়তা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে চলতি মাসেই দেশব্যাপী ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য কল সেন্টার, প্রসেসিং সেন্টার, সার্ভিস সেন্টার প্রভৃতি খোলা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভ্যাট রিটার্ন দাখিলে উৎসাহিত করতে ‘ট্যাক্স পে অনার্ড কার্ড’ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই কার্ড দিয়ে ব্যবসায়ীরা কেনাকাটায় ছাড় ও সরকারী পর্যায়ে বিশেষ সুবিধা পাবেন। এই মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সচিব নজিবুর রহমান। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এনবিআর সদস্যা (শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) এবং ভ্যাট আইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রেজাউল হাসান। ভ্যাট আইনের নানা দিক তুলে ধরেন এনরবিআর সদস্য (ভ্যাটনীতি) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন ও ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক জাকির হোসেন। শনিবার দুপুরে কাকরাইল আইডিইবি সম্মেলন কেন্দ্রে নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের সম্মেলন কক্ষে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মির্ডিয়ার বিজনেস এডিটর, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সংবাদকর্মীরা যোগ দেন। এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে কোনভাবেই জনসাধারণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য সম্পূর্ণ ভ্যাটের বাইরে রাখা হয়েছে। তাই বাজারে এই পণ্যগুলোর দাম বাড়ার কোন সুযোগ নেই। নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বচ্ছ, আধুনিক, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি যোগাযোগবিহীন, সার্বক্ষণিক, সময়োপযোগী, সর্বোপরি দেশী-বিদেশী ব্যবসাবান্ধব ও চাহিদার উপযোগী একটি আইন এটি। বিভিন্ন আঙ্গিকে নতুন আইন পুরনো আইনের চেয়ে উৎকৃষ্ট।’ তিনি বলেন, আইনটি পরিচালিত হবে সম্পূর্ণ অনলাইন ভিত্তিতে। মানুষে মানুষে কোন যোগাযোগ না থাকার কারণে দুর্নীতির কোন সুযোগ থাকছে না। সব কিছুই হবে অনলাইন ভিত্তিতে। নজিবুর রহমান বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে ভ্যাটের রেট নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এ ব্যাপারে যৌথ কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এসব সুপারিশ সরকার বিবেচনা করছেন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে যে নির্দেশনা আসবে সে অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাজ করবে। রেজাউল হাসান বলেন, পুরনো ভ্যাট আইনে অনেক ক্রটি বিচ্যুতি ছিল। সেগুলো কাটিয়ে উঠে নতুন ভ্যাট আইন করা হয়েছে। এই আইন আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার ভিত্তিতে প্রণীত। এতে দেশীয় শিল্পের ন্যায্য সুরক্ষা, রফতানিমুখী খাতে সুবিধা, আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ে (মৌলিক চাহিদা, খাদ্য ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি) বিষয়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া আছে। শীঘ্রই কয়েক পৃষ্ঠার দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করা হবে। পুরনো আইনে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য কোন অব্যাহতি ছিল না। নতুন আইনে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার হলে ভ্যাট দিতে হবে না। এছাড়া ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার হলে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি টার্নওভার কর দিতে হবে। এ হারটি অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা দেবেন। ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভ্যাট কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়াই ব্যবসায়ী নিজের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন। বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য মাত্র একটি নিবন্ধন নেয়ার সুবিধা থাকছে। নতুন আইনে ভ্যাট কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতা বাড়ানো হয়েছে এবং অহেতুক শিল্প কারখানা পরিদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভ্যাট কর্মকর্তারা সেবার মনোভাব নিয়ে ‘হালখাতা’ ও ‘মেলা’র পরিবেশে দায়িত্ব পালন করবেন। এজন্য এনবিআর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, নতুন আইন সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হবে। ফলে ব্যবসায়ীরা নিবন্ধনকরণ, রিটার্ন প্রদান, অনলাইন পেমেন্ট, রিফান্ড, ইত্যাদি সহজে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে পারবেন। এতে ব্যবসার ও উৎপাদনের খরচ কমবে এবং জনসাধারণ উপকৃত হবেন। নতুন আইনে প্রচলিত আইনের মতোই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রকৃত ভ্যাট হার দাঁড়াবে ১৩.০৪ শতাংশ। সব পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত করে হিসাব নির্ধারণের পদ্ধতি অনূসৃত হওয়ায় পণ্য ও সেবার মূল্য কমবে।
×