ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দলীয় প্রধানের কাছে তৃণমূল নেতাদের অভিযোগের অন্ত নেই

মন্ত্রী এমপিরা জামায়াত বিএনপিকে দলে ভেড়াচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২১ মে ২০১৭

মন্ত্রী এমপিরা জামায়াত বিএনপিকে দলে ভেড়াচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বর্ধিত সভায় দলের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতার কথা ফুটে উঠেছে তৃণমূল নেতাদের কণ্ঠে। দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা এনে দিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানিয়ে তৃণমূল নেতারা বলেছেন, দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী কিছু নেতার কারণে তৃণমূলে ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এমপি-মন্ত্রীরা নিজস্ব বিশেষ বলয় গড়ে তুলতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরকে দলে ভেড়াতেও দ্বিধা করছেন না। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে পারলে আগামী নির্বাচনে পুনর্বার বিজয়ের পথে কোন বাধা থাকবে না। শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সারাদেশ থেকে আসা দলটির প্রাণশক্তি তৃণমূল নেতাদের ভেতর থেকে এসব দাবি জানানো হয়। তৃণমূল নেতারা বর্ধিত সভায় বিভিন্ন জেলার রাজনৈতিক চিত্র, দলের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া নানা অসঙ্গতি, অনৈক্য-দ্বন্দ্ব, এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের দূরত্ব, দলের ভেতরে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে। এমনকি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কিছু বক্তব্যের ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চে বসে থেকে সবার বক্তব্য শোনেন। পরে সবার অভিযোগ, অনুযোগ ও পরামর্শের জবাব দেন তিনি। রুদ্ধদ্বার এই সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সারাদেশ থেকে আসা ৮ বিভাগের ৮ জন নেতা বর্ধিত সভায় বক্তব্য রাখেন। বর্ধিত সভায় খুলনা জেলার সভাপতি হারুন উর রশীদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা এনে দিলে ‘শেখ হাসিনার সরকার বার বার দরকার’- এই সেøাগানও দিতে হবে না। আমরা বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দেখেছি আপনি (শেখ হাসিনা) মনোনয়ন দেন। কিন্তু নৌকার বিরুদ্ধে আরেকজন দাঁড়িয়ে যায়। তাই দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অতিব জরুরী হয়ে পড়েছে। দলের বিরুদ্ধে যদি আমিও যাই আমার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। তিনি বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলায় সহযোগী সংগঠনের কমিটি হয় অথচ আমি জানি না। সেই সহযোগী সংগঠন সবাই কমিটি দেয় ঢাকায় বসে। কয়দিন আগে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও এস এম জাকির হোসেনের সঙ্গে কথা বলি, তারা বলে দেখছি। এরপর আরও সময় চলে যায়। এভাবেই চলছে সব সহযোগী সংগঠন। তিনি বলেন, দলের মুখপাত্র যাতে একজন হয়। দলের সিদ্ধান্ত একজনই বলবেন। বেশি লোক দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বললে আমরা বিব্রত হই। রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর কাদেরের কিছু মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঝে মধ্যে এমন কথা বলেন তখন আমরা ভীত হয়ে পড়ি। দল বুঝি আর ক্ষমতায় আসবে না। তাছাড়া উনার বক্তব্যে দলীয় বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি বলেন, জেলার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কমিটি কীভাবে হয় আমরা জানি না। জেলা-উপজেলার কমিটি ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা জড়িত না থাকার ফলে জামায়াত, শিবির ও বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মীরাও আমাদের দলের জায়গা পেয়ে যায়। তিনি বলেন, এমপিরা নির্বাচিত হয়ে বলয়ের বাইরে যেতে পারেন না। আর বলয়ের কারণে অমুককে- তমুককে দিয়ে কমিটি দেয়া হয়। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়ে নানা অপকর্ম করে। তারা কাদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগে ঢুকছে সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। এগুলো শক্ত হাতে দমন না করলে আমার মতো আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতারা টিকে থাকতে পারবে না। ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি জহিরুল হক খোকা বলেন, আওয়ামী লীগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খন্দকার মোশতাক ঢুকে গেছে। নেত্রী আপনি বার বার এসব মাফ করে দেন। ফলে অপরাধীরা সাহস সঞ্চয় করে। তাই আমার সবিনয় অনুরোধ, আর মাফ করবেন না। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দেখেছি অশুভ প্রতিযোগিতা। আমার একদল আপনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছি, আরেক দল আপনাকে পিছনের দিকে টানছে। তিনি বলেন, আমাদের ভেতরে বেশিরভাগ বিরোধ আদর্শের নয়, ব্যক্তিত্বের-নেতৃত্বের। এসব বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে হবে। আগামী নির্বাচনে জাতীয়ভাবে কাজ-কর্মই শুধু জনগণ বিবেচনা করবে না, বিবেচনা করবে স্থানীয়ভাবে এমপিরা কি করছেন, সেই প্রশ্নও আসবে। সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রাজশাহী জেলার সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদ রয়েছে। তবে দ্বন্দ্বের কথা নয়, আমি বলব ঐক্যের কথা। দলে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে, তবে নিরসনের উপায় বের করতে হবে। দ্রুত সবাইকে ঐক্যের বাঁধনে বাঁধতে হবে। বরিশাল বিভাগের সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা বরিশাল বিভাগে ঐক্যবদ্ধ। তবে কোথাও কোন বিভেদ থাকলে, ভুল বোঝাবুঝি থাকলে মীমাংসা হবে না কেন? টাঙ্গাইল জেলার সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতায় যাব না। এক ও অভিন্ন থেকে এগিয়ে যাব। কেউ ভিন্ন চিন্তায় বিভক্ত হব না, এই প্রতিজ্ঞায় নিতে হবে। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরুদ্দিন আহমেদ কামরান বলেন, আমাদের সিলেট বিভাগে মোট ১৯টি আসন। সেখানে যারা বিজয়ী হয়েছেন তাদের বিজয়ী করতে তৃণমূলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর ঘাম ঝরেছে। কিন্তু বিজয়ী হয়ে সেসব এমপিদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের ফারাক তৈরি হয়েছে। ফলে আগামীতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মনোনয়ন দেবেন। তিনি বলেন, সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনগুলো কমিটি দেয়ার সময়ে আমাদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি দেয় না। ঢাকা থেকে কমিটি দেয়। আমরা অনেককে জানি না, চিনিও না। আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সংগঠন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, আমাদের সরকারের টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেই হিসেবে আমরা গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পারিনি। এমপিদের সঙ্গে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সৃষ্ট দূরত্ব কাটিয়ে তুলতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দলের স্পোকম্যান (মুখপাত্র) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্পোকম্যানের কথায় আমরা যদি বিভ্রান্ত হই তাহলে দলের আরও ক্ষতি হবে। এই বিষয়টিও নেত্রীকে দেখতে হবে। সহযোগী সব সংগঠনের অসহযোগিতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সহযোগী সংগঠনগুলো বিপরীতমুখী হলে আমরা যারা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করি তারা কিভাবে কাজ করব? তৃণমূলের ৮ নেতার বক্তব্য শেষ হলে সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রত্যেক দলীয় সংসদ সদস্যদের নিজ জেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক এমপিকে নিজ জেলার নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আমার কাছে তথ্য আছে, দল ভারির জন্য অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের দলে টানা হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংগঠনকে গতিশীল করতে সকল জেলার নেতাকে বছরঅন্তে সাংগঠনিক রিপোর্ট দিতে হবে। সারাদেশে দলের নিজস্ব কার্যালয় গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এখনও পর্যন্ত প্রত্যেক জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে নিজস্ব দলীয় কার্যালয় নেই। অথচ অনেক বিত্তশালী আমাদের দলে আছেন। আমি প্রত্যেক জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে দলীয় কার্যালয় চাই। আমাকে এ ব্যাপারে জানাবেন। আমাদের দলের নেতারাও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন। দলীয় কার্যালয়গুলো ঠিকভাবে চালু রাখতে হবে। তিনি বলেন, আজকের বর্ধিত সভা থেকে দেয়া ল্যাপটপগুলো কেউ ঘরে ফেলে রাখবেন না। সবাই দলীয় কার্যালয়ে ব্যবহার করবেন। তিনি উদ্বোধন করা সদস্য সংগ্রহ অভিযান পরিকল্পিতভাবে করার জন্যে প্রত্যেক নেতাকর্মীকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে সদস্য সংগ্রহ ফরমের মুড়ি বই ফেরত দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। বর্ধিত সভায় উপস্থিত তৃণমূল নেতাদের উদ্দেশ্যে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আপনাদের হাতে যেসব অডিও, ভিডিও সিডি দেয়া হয়েছে তা গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে প্রচার করতে হবে। একদিকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- প্রচার করতে হবে, অন্যদিকে বিএনপি কি করেছে, তাদের অপকর্ম জনসমক্ষে ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলেই লুটপাট করবে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ক্ষমতায় গেলে হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন, নতুন নতুন ভবন খুলবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যা বলে, তা বাস্তবায়ন করে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল, এটা এমনি এমনি হয়নি, আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেশ চালাই না। আমরা দেশ চালাই, দেশের সমস্যা আমরা জানি। আমরা জানি, এদেশের মানুষের সমস্যা কী। আমরা জানি কোন এলাকায় কী অবস্থা আছে। এ কারণেই সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় এবং কোন অনিয়ম যেন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্যও তৃণমূল নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
×