ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিনাজপুর ঈশ্বরদী ও যশোরের মাদ্রাজী বোম্বাই লিচু উঠছে বাজারে, দামও ভাল

এবার বাম্পার ফলন হয়েছে লিচুর, মহাখুশি চাষী

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২১ মে ২০১৭

এবার বাম্পার ফলন হয়েছে লিচুর, মহাখুশি চাষী

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘এবার লিচুর ফলন বেশ ভাল। অন্য বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গত বছর লিচু বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা আয় হলেও এ বছর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা আয়ের প্রত্যাশা রয়েছে।’ কথাগুলো বলছিলেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার মঙ্গলবাড়ীয়া গ্রামের লিচু চাষী তারিকুল ইসলাম নোসেল। একই গ্রামের আরেক লিচু চাষী সাইফুল্লাহ তারেক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘লিচুর ফলন যেমন ভাল হয়েছে তেমনি দামও পাওয়া যাচ্ছে ভাল। এখানে এক শ’ লিচু ৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে সর্বনিম্ন ৪০০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফলন ভাল পেয়ে এই দুই লিচু চাষীর মতো গ্রামের অন্য লিচু চাষীও উচ্ছ্বসিত। মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এসে লিচুর জন্য বিখ্যাত মঙ্গলবাড়ীয়ার প্রায় সবার মুখে এখন হাসি। একই অবস্থা দেশের অন্য প্রান্তেও। মৌসুমটিতে লিচুর গড় ফলন ভাল। আর লাল-গোলাপি রঙে সেজেছে গাজীপুরের শ্রীপুর। এ অঞ্চলে চলতি মৌসুমে লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এ অঞ্চলের লিচু রফতানি হয়েছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। তবে খাগড়াছড়িতে এবার ফলন কম। পাহাড়ী এই অঞ্চলটিতে লিচুর ‘অফ মৌসুম’ চলছে। সার্বিক এই পরিস্থিতিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছে, চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত লিচুর ফলন ভাল। সার্বিক উৎপাদন না বাড়লেও আগের বছরের তুলনায় কমবে না। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক গোলাম মারুফ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সারাদেশে চলতি মৌসুমে লিচুর ভাল ফলন হয়েছে। লিচু এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।’ আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক কুদরত-ই-গনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সমতলে লিচুর ফলন ভাল হয়েছে। তবে পাহাড়ে কিছু কম হবে। খাগড়াছড়িতে এবার লিচুর ‘অফ মৌসুম’ চলছে। সার্বিকভাবে গত বছরের তুলনায় লিচুর ফলন কমবে না, হয়ত বাড়বেও না।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর সারাদেশে ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ১৪ হাজার মেট্রিক টন। আর গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সারাদেশে ১ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়। তবে পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টনে। তথ্য পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, দেশে প্রতিবছরই লিচুর উৎপাদন বাড়ছে। একই কথা বলেন লিচু চাষী সাইফুল্লাহ তারেক। কিশোরগঞ্জের মঙ্গলবাড়ীয়ার বিখ্যাত লিচু সম্পর্কে জানতে কথা হয় এই চাষীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মঙ্গলবাড়ীয়ার লিচু বিশেষ গুণসম্পন্ন। দেশের অন্য যে কোন জায়গা থেকে এখানকার লিচু ভিন্ন রকম। লিচু যখন পাকতে শুরু করে তখন এই লিচু থেকে সুগন্ধ বের হয়। অন্য গ্রামের সঙ্গে মেলে না। এমনকি পাশের গ্রামেও এ ধরনের লিচু হয় না। তিনি বলেন, এখানে আগে সীমিত আকারে লিচু চাষ হতো। এখন আবাদি সম্পতিতেও অন্য ফসল বাদ দিয়ে শুধু লিচুর চাষ হচ্ছে। এতে আমরা লাভবান হচ্ছি। একই গ্রামে ৪ বাগানে প্রায় ১০০ গাছ রয়েছে তারিকুল ইসলাম নোসেলের। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ২১৫ বছর আগে থেকে এখানে লিচু হয়ে আসছে। ছোট বেলা থেকেই জেনে আসছি আমাদের মঙ্গলবাড়ীয়ার লিচু বিখ্যাত। আর লিচু মৌসুমে সেটা টের পাই। মৌসুমের পুরো সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ লিচু কিনতে আসেন। তিনি আরও বলেন, পৈত্রিক লিচুর বাগান ছিল। আর ৭ বছর ধরে আমি লিচুর বাগান দেখাশোনা করছি। আগের তুলনায় গাছও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ভাল। দামও পাওয়া যাচ্ছে। সর্বনিম্ন ৪০০ টাকা শ’তে লিচু বিক্রি হচ্ছে। চাষীরা জানান, মৌসুমটিতে ১০ দিন হয়েছে লিচু উঠতে শুরু করেছে। অঞ্চলটিতে লিচুর মৌসুম চলবে আরও অন্তত ১০ দিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরেও এবার লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। দাম পেয়ে মহাখুশি চাষীরা। জেলার জয়নাল আবেদীন বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার লিচুর ফলন হয়েছে অনেক বেশি। তাই আমাদের মন এখন অনেক খুশি। ফুলবাড়িয়া গ্রামের মান্নান জানান, আবহাওয়া ভাল থাকায় উৎপাদন ভাল। জেলাটিতে হাজার প্রতি ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় লিচু বিক্রি হচ্ছে। এদিকে, রাজশাহীতে জমে উঠেছে লিচুর বাজার। জানা গেছে, ২৩০ থেকে ৩০০ টাকা শ’ লিচু বিক্রি হচ্ছে। আর জেলায়ও লিচুর ফলন ভাল হয়েছে। অঞ্চল ভিত্তিতে লিচুর ফলন ভাল হলেও দেশের কোথাও কোথাও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাগান। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নে লিচু বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। এই এলাকায় দুটি বাগান লিজ নেন সাইফুর রহমান বাদশা। ১ হাজার ২৫৫ গাছের দুটি বাগান লিজ নিতে তার খরচ হয় ৬ লাখ টাকা। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বাগান লিজ নেয়ার পর আরও ৪ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। ১০ লাখ লিচু হওয়ার কথা ছিল। ফলনও বেশ ভাল হয়। তবে সোমবার বিকেলে বয়ে যাওয়া আকস্মিক ঝড়ে বাগানের সব লিচু ঝরে গেছে। এখন বাগানে ১ লাখের মতোও লিচু নেই। যে লিচু রয়ে গেছে সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। খাওয়ার উপযোগী নয়। এতে আমার সর্বনাশ হয়েছে। প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো ক্ষতি গুনতে হচ্ছে। কৃষিতে যদি বীমার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয় তো ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারতাম। লিচুর উৎপাদন সম্পর্কে জানতে কথা হয় বছর ব্যাপী ফল উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ মেহেদি মাসুদের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, চলতি বছর আগাম জাতের লিচুর ফলন খুবই ভাল। যশোরে মাদ্রাজি বোম্বাই লিচুর বেশ ভাল ফলন হয়েছে। এছাড়া কিশোরগঞ্জের মঙ্গলবাড়ীয়াতেও লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। স্থানীয় সোনারগাঁও জাতের লিচুর উৎপাদনও ভাল। মধ্যম বারি-২, চায়না-২, ঈশ্বরদী বোম্বাই এগুলোর ফলনও ভাল। তিনি বলেন, দিনাজপুরে বোম্বাইয়ের ফলনও ভাল, তবে চলতি বছরে চায়না-৩ জাতের ফলন একটু কম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাজারে মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিন লিচু পাওয়া যায়। তবে আমরা আগাম জাতের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে বাজারে যাতে ২ থেকে ৩ মাস লিচু পাওয়া যায়; সে লক্ষ্যে কাজ করে চলছি।
×