ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অসাধারণ এক হ্যাকারের গল্প

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২০ মে ২০১৭

অসাধারণ এক হ্যাকারের গল্প

যেভাবে শুর ॥ তিনি জানান, ক্লাস এইটে পড়ার সময় তার প্রথম পরিচয় হয় হ্যাকিংয়ের জগতের সঙ্গে। তিনি জানান, তার চেয়েও কম বয়সী ছেলেরা তখন হ্যাকিং করত বলে তিনি তখন দেখতে পান। তিনি দেখলেন, তাদের কেউ কেউ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতেও পড়ত। পরে কম্পিউটার জগতের মাধ্যমেই অন্য হ্যাকারদের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার পরিচয় ঘটতে শুরু করে। হ্যাকাররা ইন্টারনেটের যে অন্ধকার জগতে ঘোরাফেরা করেন তাকে বলা হয় ডিপওয়েব। সেখানেই সাইবার অপরাধীদের আনাগোনা। তিনি বলেন, “আমরা জানি পৃথিবীর এক ভাগ স্থল আর তিন ভাগ জল এবং সেই পানির নিচে কি আছে সেটাও কেউ জানে না। ডিপওয়েবে সেরকমই একটি জগত। গুগল, আমাজন এগুলো হচ্ছে স্থলভাগের মতো। আর ডিপ ওয়েব হচ্ছে পানির নিচে গভীর অন্ধকার জগতের মতো। অন্ধকার জগত ডিপওয়েব ॥ সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা এই ডিপওয়েবে যেতে পারে না। হ্যাকার, সাইবার ক্রিমিনাল, মাফিয়া, বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা এই জগতে বিচরণ করেন। তাদের সেই দক্ষতা রয়েছে। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশে হ্যাকিং হচ্ছে - এরকম খবরা-খবর দেখে তিনি নিজেও একদিন হ্যাকিং করার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়েছিলেন। “প্রথমে আমার মনে হলো দেখি তো জিনিসটা কি। তখন আমি গুগলে সার্চ করতে শুরু করি। জানতে চেষ্টা করি যে হ্যাকারদের ফোরাম কোথায়। এসবের কিছুটা তথ্য সেখানে পাওয়া যায়। সেখান থেকেই আমি ডিপওয়েবের সন্ধান পাই। একটি ফোরামের কথা জানতে পারি। তখন এনিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করার পর আমার রেচাখ কপালে উঠে যায়। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে এই রোমাঞ্চকর জগতেই আমাকে থাকতে হবে। তখনই তিনি শিখে যান ডিপওয়েবে কিভাবে লগ ইন করতে হয়, কিভাবে সার্চ করতে হয়, তারপর শেখেন কিভাবে অন্যের কম্পিউটারে হানা দেয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ওই ডিপওয়েবেই এক এক করে আরও অনেক হ্যাকারের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটতে শুরু করে। তিনি জানান, তারপর তিনি নিজে নিজেই ধীরে ধীরে সবকিছু শিখতে শুরু করেন। কিভাবে শেখা ॥ নিজের ঘরে ছোট্ট একটা ল্যাপটপ কোলের ওপর বসিয়ে দিনরাত কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কাজ মানে হ্যাকিং শেখা। এক পর্যায়ে সেটা তার নেশার মতো হয়ে দাঁড়ায়। তিনি জানান, কখনও কখনও টানা তিন থেকে চারদিনও ঘরের দরজা বন্ধ করে কম্পিউটার নিয়ে বসেছিলেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। কেউ যদি বলে যে ভাই আমি হ্যাকিং শিখতে চাই সে জীবনেও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু যদি নিজের আগ্রহ থাকে তাহলে সে নিজে নিজেই আস্তে আস্তে একদিন অনেক কিছুই শিখে ফেলবে। তিনি অবশ্য দাবি করেছেন, কারও ব্যক্তিগত কম্পিউটারে তিনি কখনও আক্রমণ করেননি। যা কিছু করেছেন তার সবটাই ছিল সাইবার যুদ্ধের অংশ। অবৈধ কিছু আমি করিনি। শুধু কিছু তথ্যের জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে হয়ত তার ভেতরে ঢুকে পড়েছি। তারপর সেখান থেকে একসময় চুপচাপ বেরিয়েও আসতাম, বলেন তিনি। তার মতে, হ্যাকাররা আসলে খারাপ না। খারাপ হচ্ছে ক্র্যাকার। “যারা হ্যাকার তারা হয়ত কোন একটা ওয়েবসাইট হ্যাক করবে, সাইবার ওয়ার করবে দেশের পক্ষে। কিন্তু যারা ক্র্যাকার তারা বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কে আক্রমণ করে, ক্রেডিট কার্ড থেকে তথ্য চুরি করে অর্থ সরিয়ে নেয়া। ব্যক্তিগত কম্পিউটারে আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করে। সাইবার যুদ্ধ ॥ নিজে কিভাবে সাইবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন জানতে চাইলে সাবেক এই হ্যাকার বলেন, হঠাৎ করে আমি দেখলাম আমার দেশে একটা সাইবার আক্রমণ হলো। দেখলাম কোন একটা ওয়েবসাইট ধসিয়ে দিয়ে সেখানে হ্যাকাররা আমাদের দেশকে গালাগাল করছে। তখন আমি তার প্রতিশোধ হিসেবে একটার বদলে তাদের এক শটা ওয়েবসাইটে এ্যাটাক দিলাম। তিনি দাবি করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যখন সাইবার যুদ্ধ হয় সেসময় তার রণকৌশল তৈরি করতেন তিনি। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আরও অনেক হ্যাকার তখন এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এই হ্যাকাররা কেউ কাউকে চেনেন না, কে কোথায় থাকে জানেন না, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা আইডি আছে, সেসবের মাধ্যমেই তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়। তিনি বলেন, কোন্ দেশের সঙ্গে আমাদের যখন সাইবার যুদ্ধ চলে তখন আমাদের নীতি হলো আমার দেশের জন্যে আমি যেটাই করি সেটাই হালাল। আমাকে জিতে আসতে হবে। এটা হচ্ছে সোজা কথা। এর জন্যে আমাকে যত নিচে নামতে হবে আমি নামব। কোন অসুবিধা নেই- এটাই হলো আমাদের নীতি, বলেন তিনি। অনেক সময় দেখা গেছে, আমাদের পাল্টা সাইবার আক্রমণের কারণে পাকিস্তানী হ্যাকারদের পেছনে থানা পুলিশও লেগে যেত। তারা তাদের বলত যে তোমাদের জন্যে আমাদের দেশে সাইবার হামলা হচ্ছে। একই রকমের ঘটনা ঘটত বাংলাদেশেও। সাইবার যুদ্ধের কৌশল ॥ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই হ্যাকার জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে সাইবার যুদ্ধের সময় তারা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করতেন। একটি গ্রুপের কাজ ছিল পাকিস্তানের ওয়েবসাইটগুলোতে আক্রমণ করা আর অন্য গ্রুপটি হ্যাকিং ঠেকাত বা হ্যাকিংয়ের শিকার হলে ওই ওয়েবসাইট পুনরায় সচল করে দিত। পাকিস্তানীরা হয়ত এক শটা ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে কিন্তু তারা দেখল যে মাত্র কুডয়াটি হ্যাক হয়েছে। তার অর্থ বাকি ৮০টি সাইট আমরা ইতোমধ্যেই সচল করে ফেলেছি। তখন তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত। তিনি জানান, পাকিস্তানে সাইবার আক্রমণের সময় তারা হিটলারের ‘বিটজ ক্রিগ’ কৌশল অনুসরণ করতেন। সবকিছু নিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একসঙ্গে ১০০টা আক্রমণ করা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকা। তারপর আবার একসঙ্গে অনেক আক্রমণ করা। এভাবে আমরা ওদের ভয়ে হতভম্ব করে দিতাম। তিনি জানান, পাকিস্তান ছাড়াও তিনি ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গেও সাইবার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তিনি জানান, ইউরোপ আমেরিকার সরকারী নিরাপদ ওয়েবসাইটগুলোতে তারা ঢুকেছিলেন। বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করেন ইসরালী ওয়েবসাইট হ্যাক করার কথা। ইসরালে একটি ওয়েবসাইট হ্যাক হলেই সেটা আন্তর্জাতিক খবর হয়। কারণ দেশটির সাইবার নিরাপত্তা খুবই কঠোর। কিন্তু এমন দিন গেছে যে আমরা একদিনেই ৪০ থেকে ৫০টি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছি। তিনি জানান, সারাবিশ্বে হ্যাকারদের এরকম কয়েক হাজার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। হ্যাকারদের ভবিষ্যত ॥ হ্যাকারদের এই প্রতিভা ও দক্ষতার জন্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে তাদের চাকরিও দেয়া হয়। তাদের নেয়া হয় হ্যাকিংয়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে। তিনি জানান, অনুতাপ থেকে অনেকে একসময় হ্যাকিং করা ছেড়ে দেন। কারণ তারা বুঝতে পারেন যা করা হচ্ছে সেটা ঠিক নয়। তবে তিনি বলেন, যারা অন্য দেশের সঙ্গে সাইবার যুদ্ধ করেন তাদের মধ্যে হয়ত এই অনুতাপটা কাজ করে না। এখন তিনি আর হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত নেই। চাকরি করেন একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য-প্রযুক্তিবিদ হিসেবে। তার কাজ হচ্ছে, সাইবার আক্রমণের হাত থেকে ওই প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করা। তিনি বলেন, আমি দেখলাম, সাইবার এ্যাটাক করে মনের যতটা শান্তি হয় তারচেয়েও বেশি শান্তি পাই সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে পারলে। বিবিসি অবলম্বনে
×