ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামে বসে স্বজন কুটুমের মিলনমেলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২০ মে ২০১৭

গ্রামে বসে স্বজন কুটুমের মিলনমেলা

ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক ঝিক। বাইরে দমকা ঝড়ো হাওয়া বইছে। সঙ্গে থেমে থেমে বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপটা কখনো কখনো জানালা দিয়ে ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ট্রেনের দুই ক্ষুদে যাত্রী অনু আর অলি বাবা-মায়ের সঙ্গে উঠেছে রংপুর স্টেশন থেকে। গন্তব্য নানাবাড়ি। লালমনিরহাটের আদিতমারী। দু’ ভাইবোন জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। আর লাফাচ্ছে আনন্দে। বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। খেয়াল থাকার কথাও নয়। এখন চলছে মধুমাস ‘জ্যৈষ্ঠ’। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে তারা নানাবাড়ি যাচ্ছে। এ সময়টির অপেক্ষায় তারা বছরব্যাপী দিন গুনেছে। দু’ ভাইবোন অস্থির হয়ে আছে; কতক্ষণে ট্রেনটি আদিতমারী স্টেশনে পৌঁছবে। তাদের মনে হচ্ছে ট্রেনটি আজ বড় বেশি ধীরে চলছে। বড় বোন অনু গুনগুনিয়ে মনের আনন্দে গলায় তুলেছে সুর। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামা বাড়ি যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়োতে সুখ; পাকা জামের মধু রসে রঙিন করি মুখ।’ এদিকে মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি আসবে বলে পথ চেয়ে বসে আছেন তাজউদ্দীন সিদ্দিকী। বৈশাখ পেরিয়ে প্রকৃতিতে এখন জ্যৈষ্ঠ। এ মাসেই আম, কাঁঠাল, লিচু, জামসহ নানাজাতের ফল পাকতে শুরু করে। পাকা ফলের মিষ্টি গন্ধ সহজেই মন কাড়ে। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা তাজা ফলের পরশ অসাধারণ অনুভূতির জন্ম দেয়। মধুমাসে তাজা ফলের স্বাদ নিতে কে না চায়! গাছে গাছে ফল পেকেছে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তালশাঁস, আমড়া, জামরুল আরও কত কী। গাঢ় সবুজ আমের শরীরে সিঁদুরের ছোপ লেগেছে। পাকা লিচুর লোভে লিচুগাছ ঘিরে দিনে পাখি আর রাতে বাদুড়ের কোলাহল। পাকা জামের মধুর রসে মুখ রঙিন করার স্বপ্নদোলা। তরমুজ, বাঙ্গি মাঠে আছে। পেয়ারা খেয়ে ফেলছে পাখি। কাপড় দিয়ে কিছু বেঁধে রাখা হয়েছে। টসটসে পেয়ারা পাহারা দিয়েও রাখা যায় না। বাড়িতে লিচুর গাছ আছে বেশ কয়েকটি। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে গাছের ডালে বসে ফল খায়। নাতি-নাতনির জন্য পরম যতেœ রক্ষা করছেন সেই লিচু। তাজউদ্দীনের ধারণা জ্যৈষ্ঠ মাসে মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি না এলে মধুমাসের মিষ্টি ফল তিনি খেতেই পারবেন না। মেয়ে-জামাই আসবে বলে বাড়িতে সব আত্মীয় আগেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন। আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে মধুমাস অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাস উদযাপন, আম-মুড়ি, আম-দুধ, কাঁঠাল-খই আহ! একসঙ্গে বসে মজা করে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। এ শুধু তাজউদ্দীনের বাড়ির গল্প নয়। এটি হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মজাদার ফল ও বাহারি ফুলের পসরা নিয়ে যখন মধুমাস হাজির হয়। রসালো ফলের ম ম গন্ধে উতলা হয় প্রকৃতি। তখন গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরেই দাদা-নানারা এভাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে মধুমাস উদযাপনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। পাড়া-পড়শী, নিকট ও দূরের আত্মীয়রাও এ উপলক্ষে মিলিত হয়। এ যেন কুটুমবাড়ির মিলনমেলা। তবে স্বজনদের মধ্যে ‘জামাই’ সবচেয়ে বেশি আদর-সমাদর পেয়ে থাকে। কথায় বলে, শ্বশুরবাড়ি মধুর হাঁড়ি। বাঙালী সংস্কৃতিতে ‘জামাই আদর’ বলে একটা কথা আছে। মধুমাস উপলক্ষে মৌসুমী ফল ছাড়াও নানারকম খাবারের আয়োজন করে শ্বশুর-শাশুড়ি। আত্মীয়ের চাপেই হোক আর পারিপার্শ্বিকতা ভেবেই হোক, জামাইকেও খেতে হয় নানারকম খাবার। নতুন জামাই হলে তো কথাই নেই! পাতে একের পর এক পড়তে থাকে রাজভোগ বা মুরগা-মুসাল্লামের মতো নানাপদের খাবার। আদুরে শ্যালিকা-শ্যালকের আবদারে হয়তো একটু বেশিই খেতে হয়। একথা না বললে নয়, শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ছয়টি ঋতু আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। সে কারণে নানাভাবে, বিচিত্র আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঋতু বৈচিত্র্য উপভোগ করে উৎসব প্রিয়, ভোজন রসিক বাঙালী জাতি। যা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির মধ্যে তেমন দেখা যায় না। এসব উৎসব শুধু লৌকিকতা নয়। এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সুদৃঢ় হয় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। বর্তমানে মানুষের জীবনযাপনের মান বেড়েছে। বেড়েছে আকাঙ্খাও। ক্রমবর্ধমান আকাঙ্খা পূরণ করতে গিয়ে মানুষের ব্যস্ততাও বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ সমাজে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান ও ঐতিহ্য কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু মধুমাসে কুটুমবাড়ির মধুর মিলনের রীতি এখনও চলমান রয়েছে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে। মধুমাস উদযাপনের এই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন বাঙালী জাতির অতিথি পরায়নতা ও উদারতারই স্বাক্ষর বহন করে। Ñআবদুর রউফ সরকার রংপুর থেকে
×