ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সাক্ষাতকার ॥ ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই যিনি দেখেছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত!’

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ মে ২০১৭

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সাক্ষাতকার ॥ ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই যিনি দেখেছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যত!’

(গত মঙ্গলবারের পর) ইসলাম হচ্ছে মানুষের সাম্যের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বজনীন আহ্বান। তারা জানে যে ইসলাম হচ্ছে একজন নবীর ঘোষণা, যিনি স্রষ্টাকে উপাসনা করতে বলেন, নিজেকে নয়। ইসলাম মানে সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হতে মুক্তি এবং স্রষ্টা, ন্যায়নিষ্ঠ কর্ম ও জ্ঞানÑ এই তিনের ভিত্তিতে সমাজের পুনর্গঠন। বস্তুত. আমাদের মুসলমানদের আচরণের কারণেই অমুসলিমরা ইসলামের প্রতি বিরাগভাজন হচ্ছে। আমরা যদি আমাদের স্বার্থপর উচ্চাকাক্সক্ষাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইসলামকে অপবিত্র না করতাম, তাহলে অনেক সত্যান্বেষী মানুষই ইসলামের মধ্যে সান্ত¡না খুঁজে পেত। পাকিস্তানের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। পাকিস্তান হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থে মুসলিম লীগ কর্তৃক উত্থাপিত একটি রাজনৈতিক দাবি। আমি মনে করি, এটা মুসলমানদের সমস্যার কোন সমাধান নয়; আসলে এটা মুসলমানদের জন্য আরও সমস্যা বয়ে আনবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ পুরো পৃথিবীটাই আমার জন্য মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন।’ এখন আমাকে বলবেন না যে, এই মসজিদ ভাগ করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে হবে। যদি নয় কোটি মুসলমান পুরো ভারতজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত এবং এক-দুই অঞ্চলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে প্রদেশগুলোকে পুনর্সংগঠনের দাবি জানানো হতো, তাহলে হয়তবা সেটা বোধগম্য হতো। আবার এই ধরনের দাবিও ইসলামিক দৃষ্টিতে সঠিক নয়, কিন্তু প্রশাসনিক কারণে সমর্থনযোগ্য। তবে বর্তমান অবস্থা বহুলাংশেই ভিন্ন। ভারতের সীমান্তবর্তী সবগুলো প্রদেশই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের সীমানা অন্য মুসলিম দেশের সঙ্গে সংযুক্ত। আমাকে বলেন, এই জনগোষ্ঠীকে কি কেউ উচ্ছেদ করতে পারে? পাকিস্তান দাবি করে মূলত আমরা গত ১০০০ বছরের ইতিহাস থেকে নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছি এবং যদি আমি মুসলিম লীগের পরিভাষায় বলি, ৩০ মিলিয়নের অধিক মুসলমানকে ‘হিন্দু রাজ’ এর কোলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে সেটা দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদের উৎস হয়ে থাকবে এবং বহির্শক্তির ইন্ধনে ভবিষ্যতে যে কোন সময় এটা ভয়াবহ যুদ্ধের আকার ধারণ করবে। একটা প্রশ্ন প্রায়ই উঠছে যে, পাকিস্তান ধারণা যদি মুসলমানদের জন্যে এতই বিপদের কারণ হয়, তাহলে হিন্দুরা এর বিরোধিতা করছে কেন? আমি মনে করি, এই বিরোধিতা দুটি পক্ষ থেকে আসছে। একপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, স্বাধীন, অখণ্ড ভারত নিজেকে রক্ষা করতে সুবিধে পাবে। বিপরীতে, আরেকপক্ষ পাকিস্তানের বিরোধিতা করছে মুসলমানদের তাদের দাবির প্রতি উস্কে দেয়ার জন্যে যেন মুসলমানদের থেকে তারা রেহাই পায়। মুসলমানদের সাংবিধানিক সুরক্ষা দাবি করার অধিকার অবশ্যই আছে, কিন্তু ভারত ভাগ তাদের স্বার্থ সিদ্ধ করবে না। এই দাবি সাম্প্রদায়িক সমস্যার ভ্রান্ত রাজনৈতিক সমাধান। ভবিষ্যতে ভারত সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন না হয়ে শ্রেণী সমস্যার সম্মুখীন হবে; মূল দ্বন্দ্ব হবে পুঁজি ও শ্রমের। কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেড়েই চলছে এবং এটা উপেক্ষা করাও সম্ভব হবে না। শোষিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় এই আন্দোলনগুলো ক্রমশই সংগ্রাম করে যাবে। মুসলমান পুঁজিপতি শ্রেণী এবং সামন্তশ্রেণী আসন্ন এই হুমকিতে ভীত। তাই, তারা পুরো বিষয়কে একটা সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছেন এবং অর্থনৈতিক ইস্যুকে ধর্মীয় বিবাদে পরিণত করেছেন। কিন্তু এটার জন্যে শুধু মুসলমানরা দায়ী না। প্রথমত এই কৌশল ব্রিটিশ দ্বারাই গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে আলীগড়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এটাকে সমর্থন করেন। সেই সঙ্গে হিন্দুদের অদূরদর্শিতা বিষয়টাকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং এখন স্বাধীনতা এই ভারত ভাগের উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছে। জিন্নাহ নিজেও এককালে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের দূত ছিলেন; কংগ্রেসের এই সভাতেই সরোজিনী নাইডু তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি দাদাভাই নওরোজীর শিষ্য ছিলেন। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের এক প্রতিনিধি দলেÑ যারা ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শুরু করেÑ তিনি যোগ দিতে অস্বীকার করেন। ১৯১৯ সালে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবেই তিনি যৌথ নির্বাচন কমিটিতে মুসলমানদের দাবির তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবরে, টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখা এক চিঠিতে- ‘কংগ্রেস হিন্দুদের সংগঠন’- এই দাবি তিনি উড়িয়ে দেন। ১৯২৫ এবং ১৯২৮ সালের সর্বদলীয় অধিবেশনে তিনি যুক্তভোটের (লড়রহঃ বষবপঃড়ৎধঃব) পক্ষে দৃঢ় সমর্থন দেন। ১৯২৫ সালের জাতীয় পরিষদের ভাষণে বলেন, ‘প্রথমত এবং শেষত আমি একজন জাতীয়তাবাদীই’ এবং সেই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সহকর্মীদের ‘সভার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ইস্যু না তুলতে এবং এই পরিষদকে সত্যিকার অর্থে একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে’ উপদেশ দেন। ১৯২৮ সালে, সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য কংগ্রেসের আহ্বানকে জিন্নাহ সমর্থন করেন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত ভাগের পক্ষে ছিলেন না। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কাছে তিনি হিন্দু মুসলমান ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে জোর দিতেন। কিন্তু, যখন মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস সাত প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করল তিনি তখন ক্ষুব্ধ হন। ১৯৪০ সালে মুসলমানদের রাজনৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে তিনি দেশভাগের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পাকিস্তান দাবি হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতারই ফসল। আমার সম্পর্কে যে কোন মতামত দেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার মি. জিন্নাহর আছে, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তান দাবিকে শক্তিশালী করে তুলতে তিনি প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। এখন এটা তাঁর কাছে সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং কোন কিছুর মূল্যেই তিনি এই দাবি ছাড়বেন না। প্রশ্ন : এটা পরিষ্কার যে, মুসলমানরা পাকিস্তান দাবি থেকে পিছু হটবে না। কিন্তু সবধরনের যুক্তি-তর্ক-বিচারবোধ তাদের কাছে অভেদ্য ঠেকছে কেন? উত্তর : কোন উচ্ছৃঙ্খল জনতার অসঙ্গত উদ্দীপনার বিপক্ষে লড়াই করা কঠিন, অসম্ভবও বটে। কিন্তু, কারও বিবেককে দমন করা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। আজকে মুসলমানরা হাঁটছে না, তারা ভাসছে। সমস্যাটা হচ্ছে যে, মুসলমানরা স্থিরগতিতে হাঁটা শেখেনি; হয় তারা দৌড়ায়, না হয় স্রোতের সঙ্গে ভেসে বেড়ায়। যখন কোন গোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা হারিয়ে যায়, তখন তারা বিভিন্ন কাল্পনিক সন্দেহ ও বিপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে এবং সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য নিরুপণেও অক্ষম হয়ে পড়ে। সংখ্যাগত শক্তি দিয়ে জীবনের মূল অর্থ অনুভব করা যায় না, বরং দৃঢ় বিশ্বাস এবং ন্যায়নিষ্ঠ কাজের দ্বারাই তা করা যায়। ব্রিটিশের রাজনীতি মুসলমানদের মানসজগতে ভয় ও অবিশ্বাসের চারা রোপণ করেছে। এখন তারা ত্রাসজনক অবস্থায় আছে, ব্রিটিশদের প্রস্থানে তারা বিলাপ করছে এবং বিদেশী প্রভুর বিদায়ের পূর্বেই দেশভাগের দাবি তুলছে। তারা কি বিশ্বাস করে যে, দেশভাগ তাদের জীবনের সকল বিপদকে প্রতিহত করবে? যদি এই বিপদগুলো বাস্তবিক হয়ে থাকে, তাহলে এগুলো তাদের সীমানায় হানা দেবে এবং যে কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ জীবন ও ধনসম্পত্তির আরও ক্ষতি বয়ে আনবে। প্রশ্ন : কিন্তু, হিন্দু মুসলমান তো ভিন্ন মতবাদের দুটি ভিন্ন জাতি, যাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। তাদের মধ্যে কিভাবে ঐক্য স্থাপন করা যাবে? উত্তর : এটা খুব সেকেলে বিতর্ক। এই বিষয়ের উপর আল্লামা ইকবাল ও মাওলানা হুসাইম আহমাদ মাদানির মধ্যে পত্রবিনিময়গুলো আমি দেখেছি। কোরআনে ‘কওম’ শব্দটি শুধুমাত্র বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়নি বরং এটা সাধারণ মানুষের স্বতন্ত্র গোষ্ঠী বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। মিল্লাত (সম্প্রদায়), কওম (জাতি) ও উম্মত (গোষ্ঠী)- এই শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থের বিতর্ক তুলে আসলে আমরা কি আদায় করতে চাচ্ছি? ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে ভারত হচ্ছে বিভিন্ন মানুষদের বাসস্থানÑ হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, পার্সি, শিখ ইত্যাদি। হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক, কিন্তু এই ভিন্নতা যেমন ভারতের স্বাধীনতার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না, তেমনি দুটো স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ভারতের ঐক্যের ধারণাকে নাকচ করে দেয় না। এখানে ইস্যুটা হচ্ছে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার এবং কিভাবে আমরা সেটা নিশ্চিত করতে পারি। স্বাধীনতা (ঋৎববফড়স) হচ্ছে একটা আশীর্বাদ এবং প্রতিটা মানুষের অধিকার। এটা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা যাবে না। মুসলমানদের উপলব্ধি করতে হবে যে, তারা এক সার্বজনীন বার্তার বাহক। তারা কোন জাতিগত কিংবা আঞ্চলিক গোষ্ঠী নয় যেখানে অন্যরা প্রবেশ করতে পারবে না। নির্মম সত্য হচ্ছে, ভারতের মুসলমানরা এক সম্প্রদায় নয়; তারা বিভিন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত উপদলে বিভক্ত। তাদের আপনি হিন্দু-বিদ্বেষে উত্তেজিত করে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন কিন্তু ইসলামের নামে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন না। তাদের কাছে ইসলাম মানে তাদের উপদলের প্রতি নিছক আনুগত্য। ওয়াহাবি, সুন্নি এবং শিয়া ছাড়াও আরও অনেক গোষ্ঠী আছে যারা বিভিন্ন সাধু ও সন্ন্যাসীদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। নামাজে হাত তোলা এবং জোরে আমিন বলার মতো ছোট ছোট ইস্যুগুলো প্রচুর বাদানুবাদ সৃষ্টি করেছে যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। উলেমারা তাকফির উপাদানটাকে (কাউকে অবিশ্বাসী আখ্যা দেয়ার ফতোয়া) যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে থাকেন। পূর্বে তারা ইসলামকে অবিশ্বাসীদের কাছে নিয়ে যেতেন; এখন তারা ইসলামকে বিশ্বাসীদের কাছ থেকেই দূরে নিয়ে যান। ইসলামের ইতিহাস ভাল ও ধার্মিক মুসলমানদের কাফির আখ্যায়িত করার ঘটনায় পরিপূর্ণ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সামর্থ্য একমাত্র নবীদেরই ছিল। কিন্তু তাদেরও তো অনেক কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বস্তুত যখন যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তা লোপ পায় এবং আচরণগুলো জীবাশ্মে পরিণত হয় তখন যে কোন সংস্কারকের কাজটিই খুব কঠিন হয়ে যায়। তবে বর্তমানে পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় আমাদের অবস্থা খারাপ। মুসলমানরা সাম্প্রদায়িকতাকেই আঁকড়ে ধরেছে; তারা ধর্মের চেয়ে রাজনীতিকেই বেশি পছন্দ করছে এবং ধর্মের আদর্শের মতো করে তাদের পার্থিব আকাক্সক্ষাকে অনুসরণ করছে। ইতিহাসে দেখা যায়, প্রত্যেক যুগে আমরা এমন কিছু মানুষকে নিয়ে উপহাস করেছি যারা আমাদের ভাল করতে এসেছিল; তাদের আত্মত্যাগ ও নিঃস্বার্থ কাজকে অবজ্ঞায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। আমরা তো সাধারণ মানুষ; এমনকি নবীরাও এসব রীতিনীতি আঁকড়ে ধরা মানুষদের হাত থেকে রেহাই পাননি। প্রশ্ন : আপনি তো বহুদিন আগেই ‘আল-হিলাল’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা কি মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষয়ের প্রতি আপনার হতাশা থেকে নাকি এটা আপনার কাছে অরণ্যে রোদন বলে মনে হচ্ছিল? উত্তর : ‘আল হিলাল’ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছি, এর অর্থ এই না যে, এর সত্যতার প্রতি আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই পত্রিকা মুসলমানদের একটা বড় অংশের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তারা ইসলাম, মানব মুক্তি এবং ন্যায়নিষ্ঠ লক্ষ্যের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে আরও জোরদার করেছিল। বস্তুত এই অভিজ্ঞতা আমার ব্যক্তিগত জীবনকেও অনেক সমৃদ্ধ করেছিল এবং আমি নিজেকে ওই মানুষগুলোর মতো অনুভব করতাম যারা সরাসরি নবীর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল। আমার নিজের কণ্ঠই আমাকে মোহিত করে এবং এর প্রভাবে আমি ফিনিক্সের মতো পুড়ে গিয়ে নতুন জীবন পেলাম। আল-হিলাল তার উদ্দেশ্য সাধন করেছে এবং এক নতুন যুগ শুরু হচ্ছিল। আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই আমি পরিস্থিতিকে পুনর্মূল্যায়ন করি এবং নিজেকে জাতীয় মুক্তির স্বার্থে পুরোপুরি নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এশিয়া এবং আফ্রিকার স্বাধীনতা বহুলাংশে নির্ভর করবে ভারতের স্বাধীনতার উপর এবং ভারতের স্বাধীনতার চাবিকাঠি হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, ভারত স্বাধীন হবেই, এবং পৃথিবীর কোন শক্তিই এটা রোধ করতে পারবে না। মুসলমানদের ভূমিকা নিয়েও আমি পরিষ্কার চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম। আমি তীব্রভাবে চাচ্ছিলাম যে, মুসলমানরা যেন নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে হাঁটতে শিখে এবং ইতিহাস যেন কখনও বলার সুযোগ না পায় যে, ভারতীয়রা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, মুসলমানরা দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। কেউ যেন বলতে না পারে যে, ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিবর্তে মুসলমানরা তীরে দাঁড়িয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা ডুবতে দেখার হর্ষধ্বনি উপভোগ করছিল। (সমাপ্ত) http://www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/41006 মূল ইংরেজী সাক্ষাতকারের লিংক-Maulana Abul Kalam Azad : The Man Who Knew The Future Of Pakistan Before Its Creation
×