ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাফাতের সঙ্গে এক ছাত্রীর আপত্তিকর ছবি

তরুণীদের মদপানে বাধ্য করে পরে ধর্ষণ করা হয়- নাঈম

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২০ মে ২০১৭

তরুণীদের মদপানে বাধ্য করে পরে ধর্ষণ করা হয়- নাঈম

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর বনানীর রেইন ট্রি হোটেলের ধর্ষণের শিকার দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রধান তিন আসামির অনেক ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাতের সঙ্গে এক ছাত্রীর আপত্তিকর ছবিও রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ওই শিক্ষার্থীরা আইসিটি এ্যাক্ট আইনে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে গ্রেফতারকৃত আলোচিত আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হালিম জিজ্ঞাসাবাদে মামলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। সে তরুণীদের মদপানে বাধ্য করে তারপর ধর্ষণ করে। ওই ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল করত। সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল নাঈমের কাছে সেদিনের ভিডিও শেয়ার করে বলে স্বীকার করেছে। অপরদিকে প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ ধর্ষণের পর দুই তরুণী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এরপর তাদের সান্ত¡না দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন দুই ধর্ষক। আদালতে সাফাত ও সাদমান শফিক এরকমই জবানবন্দী দেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। সূত্রগুলো জানায়, সম্প্রতি ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগ আনা দুই ছাত্রীর সঙ্গে প্রধান তিন আসামির অনেক ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রধান আসামি সাফাতের সঙ্গে এক ছাত্রীর আপত্তিকর ছবিও রয়েছে। এক শিক্ষার্থী দাবি করেন, সেদিন হোটেলে একটি ছবি জোরপূর্বক তোলা হয়েছিল। পরে ফোন করে হুমকি দিয়ে বলা হয়, তারা সেসব ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেবে। তিনি জানান, এর বাইরে কিছু ছবি তারা ফটোশপের মাধ্যমে মাথা কেটে এ্যাডজাস্ট করে ফেসবুকে দিয়েছে। আর কয়েকটি ছবি আমাদের ফেসবুক থেকে নিয়ে কারসাজি করে দিয়েছে। ওই শিক্ষার্থী জানান, সামাজিকভাবে হেয় করার জন্যই ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া যারা আমার ছবি পোস্ট দিচ্ছেন তারা সম্মানহানির চেষ্টা করছেন। এ ঘটনায় আইনের সহায়তা চেয়ে আইসিটি এ্যাক্টে মামলা করতে পারেন। তিনি জানান, আমি নিজেও জানি না ঠিক কারা এ বাজে কাজগুলো করছেন। তবে আমি যেসব পেজ ও ফেসবুক ওয়াল থেকে ছবিগুলো দেখতে পেয়েছি সেসবের তালিকা করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইসিটি এ্যাক্টে মামলা করতে পারেন বলেও জানান ওই ছাত্রী। তিনি জানান, এর আগে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ বলেন, তারা সেদিন রাতে, এর আগে ও পরে কী কী করেছেন আরও ছবি পাওয়া যাবে। ওই ছাত্রী জানান, মামলার পর সঠিক তদন্ত হলে ফেসবুকে কে বা কারা আপত্তিকর ছবি পোস্ট করেছে, ছবি কারা কোন্ স্বার্থে যোগান দিয়ে সহযোগিতা করেছে সবই বেরিয়ে আসবে। স্পর্শকাতর মামলার অগ্রগতি মামলার সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, আলোচিত আসামি নাঈমকে রিমান্ডের প্রথম দিনে ভিডিওর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগে সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল ভিডিও করার কথা স্বীকার করে। ৬ মে মামলার পর সে ভয়ে মোবাইল থেকে ভিডিওটি মুছে ফেলে। সূত্রগুলো জানায়, তার এ কথা কতটুকু সত্য তা যাচাই চলছে। অবশ্য বিল্লাল মামলার আলোচিত আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হালিমের কাছে ভিডিও শেয়ার করে বলে স্বীকার করেছে। পুরো ঘটনার নাটের গুরু সাফাতের এই বন্ধু নাঈম। সেও ঘটনার দৃশ্য ভিডিওধারণ করে। তরুণীদের মদপানে বাধ্য করে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। এ কারণে তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ওই ভিডিওর সন্ধান মিলতে পারে। এর আগে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ধর্ষকদের ধারণ করা ভিডিও উদ্ধারে সাফাত এবং সাকিফ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। ভিডিওটি হোটেল থেকে উদ্ধার করা সম্ভব বলে জানা গেছে। এখন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হবে। আমারও আশা ভিডিওটি উদ্ধার করা সম্ভব। সাফাত ও সাদমান সফিক জবানবন্দীতে যা বলেন ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে জোর করে ধর্ষণ করেন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ। ধর্ষণের পর দুই তরুণী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এরপর তাদের সান্ত¡না দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন দুই ধর্ষক। আদালত ও পুলিশ সূত্রে অভিযুক্ত দুজনের জবানবন্দী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। বৃহস্পতিবার মহানগর হাকিম আহসান হাবিবের আদালতে সাফাত আহমেদ এবং হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরীর আদালতে সাদমান সাকিফের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দী শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত। জবানবন্দীতে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ বলেন, ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে হোটেল পিকাসোতে ভিকটিম দুই তরুণীর সঙ্গে বন্ধু সাদমান সাকিফের মাধ্যমে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথন হতো। ২৮ মার্চ সাদমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে দুই তরুণীকে আমন্ত্রণ করেন সাদমান। পার্টিতে আসার পর তারা সুইমিংপুলে গোসল করেন। এরপর দুই তরুণীকে নিয়ে সাফাত ও নাঈম দুই রুমে যান। রুমে কথা বলতে বলতে দুই তরুণীর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হন। একপর্যায়ে তারা জোরপূর্বক দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন। সে সময় দুই তরুণী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দুই তরুণীকে তারা বোঝান। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যায়। এর আগে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদকে ছয় দিন এবং সাদমান সাকিফকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে দেন ঢাকা মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম। ১১ মে রাতে সিলেট থেকে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ১১ মে ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিনের খাসকামরায় দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভিকটিম দুই তরুণী জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে তারা জানান, গত ২৮ মার্চ ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে তাদের নেয়া হয়। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইন ট্রি হোটেলে নিয়ে যান। জবানবন্দীতে তারা বলেন, হোটেলে যাওয়ার আগে দুজনই জানতেন না সেখানে পার্টি হবে। এ সময় তাদের সঙ্গে শাহরিয়ার নামের এক বন্ধু ছিলেন। তাদের বলা হয়েছিল, এটা একটি বড় অনুষ্ঠান। অনেক লোকজন থাকবে। হোটেলে যাওয়ার পর সাফাত ও নাঈমের সঙ্গে তারা আরও দুই তরুণীকে দেখেন। সেখানে তারা ভদ্র কোন লোককে দেখেননি। পরিবেশ ভাল না লাগায় শাহরিয়ারসহ দুই তরুণী চলে আসতে চেয়েছিলেন। তখন আসামিরা শাহরিয়ারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেন। শাহরিয়ারকে মারধর করেন। এরপর দুই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে একটি কক্ষে নিয়ে যান। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন আর নাঈম আশরাফ মারধর করেন। তারা এ ঘটনা জানিয়ে দেবেন বলে জানান। এরপর আসামি সাফাত তার দেহরক্ষীকে ওই দুই তরুণীর বাসায় পাঠান তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা এতে ভয় পেয়ে যান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। আসামিরা ভিডিওচিত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেন। তাদের কথামতো না চললে কিংবা ২৮ মার্চের ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দেন।
×