ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশী তরুণ পরমাণু বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক লাভ

রেডিয়েশনে ক্যান্সার রোগীর সুস্থ কোষ ধ্বংস থেকে রক্ষার যন্ত্র উদ্ভাবন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ মে ২০১৭

রেডিয়েশনে ক্যান্সার রোগীর সুস্থ কোষ ধ্বংস থেকে রক্ষার যন্ত্র উদ্ভাবন

সমুদ্র হক ॥ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে অতিমাত্রায় রেডিও থেরাপি দেয়ার সময় সুস্থ কোষ রক্ষা করে যন্ত্রণা লাঘব আর কিছুটা সময় বেঁচে রাখার বিশেষ ধরনের ডিজিটাল যন্ত্র উদ্ভাবন করে বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। এই যন্ত্র পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চার ধারে এবং যে কোন রেডিয়েশন এলাকার পরিবেশ তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরূপণ করে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করবে। ইতোমধ্যে ব্রিটেন, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ তার গবেষণায় উদ্ভাবিত ডিজিটাল যন্ত্রটি ক্যান্সার হাসপাতালে এবং রেডিয়েশন আওতাভুক্ত এলাকায় ব্যবহার শুরু করেছে। বাংলাদেশের এই তরুণ কৃতী পরমাণু বিজ্ঞানীর নাম ড. এ কে এম মিজানুর রহমান। বাড়ি পাবনা জেলার সাথিয়া উপজেলায়। ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিয়েশনের সঠিক মাত্রা প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যবহারের ডিজিটাল যন্ত্রটি মে মাসে মালয়েশিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন ইনোভেশন এ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিবিশনে (আইটেক্স) স্বর্ণপদক পেয়েছে। এই আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর এক হাজার উদ্ভাবন প্রদর্শিত হয়। বাংলাদেশী এই তরুণ পরমাণু বিজ্ঞানীর স্বর্ণপদক বিশ্বে অভিনন্দিত হয়। সাঁথিয়ার গ্রামের প্রাথমিক স্কুল থেকে ৪৫ বছর বয়সী এই পরমাণু বিজ্ঞানীর লেখাপড়া শুরু। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। পরে পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকার স্বাস্থ্য ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ছেলেবেলা থেকেই যে কোন বিষয়ে জানার কৌতূহল তাকে গবেষণার পথে এনেছে। তিনি লক্ষ্য করেন মরণব্যাধি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে কী কঠিন যন্ত্রণা সইতে হয়। ক্যান্সার প্রতিরোধে কোন ওষুধ ও চিকিৎসা আজও আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীদের এই ব্যর্থতা ড. মিজানকে ভাবিয়ে তোলে। বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে যে রেডিয়েশন দেয়া হয় তা অতিমাত্রার। এই রেডিও থেরাপি না দিলেও নয়। কেমোথেরাপিও যন্ত্রণাদায়ক, যা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রভাব ফেলে। রং পাল্টে যায়। মাথার চুল উঠে যায়। রেডিও থেরাপি বা রেডিয়েশন দেয়ার সময় কিছু সুস্থ কোষ বা টিস্যু নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যায়। ড. মিজানের গবেষণা শুরু এই জায়গাতেই। কিভাবে রেডিয়েশনে সুস্থ কোষগুলো রক্ষা করা যায়। প্রতিবার রেডিও থেরাপি দেয়ার সময় ক্ষতিকর কোষের পাশাপাশি অনেক সুস্থ কোষও ধ্বংস হয়। ড. মিজানের গবেষণায় রেডিয়েশনে সুস্থ কোষগুলো রশ্মির আওতায় না এসে তা কার্যকর থাকে। এই সুস্থ কোষগুলো রোগীকে পৃথিবীতে আরও কিছুকাল বেঁচে থাকতে দেবে। এই ডিজিটাল যন্ত্রটি যে কোন রেডিয়েশনের আওতাভুক্ত এলাকার পরিবেশ অনেকটা রক্ষা করতে পারবে। রেডিয়েশনের আওতাভুক্ত এলাকার মাত্রা কত তা নিরূপণ করে দেবে। সেল ফোন (মোবাইল ফোন) অপারেটরদের প্রতিটি টাওয়ার থেকেই রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মোবাইল ফোন সেটে কথা বলার সময় মানব দেহে রশ্মি প্রবাহিত হয়। এই রেডিয়েশন ক্ষতিকর। উদ্ভাবিত যন্ত্রটি রেডিয়েশনের মাত্রা বলে দেবে। সাধারণত পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের চার ধারে রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ে। যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং কখনও দুর্ঘটনা ঘটায়। এই যন্ত্রটি ক্ষতিকর মাত্রা নিরূপণ করে দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সহায়তা দেবে। ড. মিজানের উদ্ভাবিত আধুনিক যন্ত্রটি তার ডক্টরেট অব ফিলোসফির (পিএইচডি) গবেষণার একটি অংশ ছিল। গবেষণাটি বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অব সায়েন্স এ্যান্ড আইসিটি প্রকল্পের আওতায় মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সম্পন্ন করেন। গবেষণায় সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রফেসর হাইরুল আজাহার আবদুর রশীদ ও ব্রিটেনের প্রফেসর ডেভিড এ্যান্ডু ব্র্যাডলি। এই গবেষণা স্পেন, চীন, গ্রীস, আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে উপস্থাপিত হয়। ড. মিজানের স্ত্রী ড. মাহফুজা বেগম বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তাদের ১ মেয়ে ১ ছেলে। তিনি সাংবাদিক ও কলামিস্ট হাবিবুর রহমান স্বপনের ছোট ভাই। ড. মিজানুর রহমানের কথাÑ তার গবেষণা থেমে থাকবে না। বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে সম্মানের আসনে পৌঁছে দেয়া এবং মানব কল্যাণের ব্রত নিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন।
×