ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েক সিনিয়র নেতা ও বুদ্ধিজীবী সক্রিয়

কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২০ মে ২০১৭

কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করছে বিএনপি। আন্দোলন করে বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো যাবে না ধরে নিয়ে ইতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতায় মনোযোগ দিচ্ছে বিএনপি। তবে অতীতে রাজপথে নেতিবাচক কর্মসূচী পালন করে বিদেশী কূটনীতিকদের সমর্থন না পাওয়ায় এবার নতুন উদ্যমে এ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ১০ মে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করেছেন। জানা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানসহ ক’জন সিনিয়র নেতা এবং ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এ তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছেন। তারা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের লন্ডন প্রবাসী ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। সূত্রমতে, ১০ মে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন -২০৩০’ চূড়ান্ত করার আগে ক’জন বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গেও এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। সে সময় এ ভিশন সম্পর্কে কূটনীতিকরাও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। পরে দলের পক্ষ থেকে ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণার দিন উপস্থিত থাকতে ঢাকায় অবস্থানরত সবক’টি দেশের কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর তাদের এ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বেশ ক’টি দেশের কূটনীতিকরা ওয়েস্টিন হোটেলে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে ‘ভিশন-২০৩০’ এর কপি সব দেশের দূতাবাসে পাঠানো হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজছেন দলীয় হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা। এ জন্যই বর্তমান নির্বাচন কমিশন যাতে নিরপেক্ষ থাকে সে জন্য এখন নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মতে নির্বাচন কমিশন মোটামুটি নিরপক্ষ হলে আর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারকে যতটুকু সম্ভব চাপে রাখা গেলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ভাল ফল করবে। আর এ কারণেই বিএনপি এখন আবার নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করছে বলে জানা গেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের অনেক আগে থেকেই বিএনপি এ কমিশন যাতে নিরপেক্ষ হয় সে জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকে। আর এ কারণেই রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের পর বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য তৎপর হয়ে উঠে। এসব কূটনৈতিকরা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাত করতে চায়। কিন্তু সরকারী দলের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মন্তব্য করা হলে কূটনৈতিকরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে তৎপরতা না চালালেও ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে সক্রিয় থাকে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশী কূটনীতিকরা যাতে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ রাখা এবং সহায়ক সরকার গঠনের বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হন সে জন্য বিএনপি বিভিন্নভাবে তৎপরতা জোরদার করছে বলে জানা গেছে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়েন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এরপর ওইবছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন সফরে যান। লন্ডনে অবস্থানকালে তার ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলের ভবিষ্যত করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় তারা দলের জন্য সুবিধা আদায় করতে আন্দোলনের পরিবর্তে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পর থেকেই বিএনপির কিছু নেতা দেশে-বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারে অধিক সক্রিয় হয়ে পড়েন। কিন্তু বিদেশী কূটনীতিকরা নেতিবাচক কর্মসূচীর পরিবর্তে ইতিবাচক কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালে বিএনপি কৌশল পরিবর্তন করে। এর পর ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর সহায়তায় ইতিবাচক কি কর্মসূচী পালন করা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকে। অবশেষে বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণার উদ্যোগ নেয়। আর এই ভিশন প্রকাশের পর অনেক কূটনীতিক এটিকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছে বলে বিএনপি সূত্র জানায়। এদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার অংশ হিসেবে বিএনপি ভারতের সঙ্গেও নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। তবে ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকায় ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে না মনে করে বিএনপি এখন কৌশলে জামায়াতের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক শুধু আন্দোলনের এ কথাও দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য বিএনপি ২০ দলীয় জোট করেছে, যে জোটে জামায়াতও রয়েছে। সূত্রমতে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান মোর্শেদ খান, মীর মোহাম্মদ নাসির, ড. ওসমান ফারুক, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহউদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. ইউনূস, বেসরকারী সংস্থা গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী ও উবিনিগের ফরহাদ মাজহার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদসহ দেশের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিও বিএনপির পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদিআরব, অষ্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিএনপির কমিটিতে যারা আছেন তারাও প্রভাবশলী বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে লবিং করে বিএনপির জন্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ কাজে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা যখন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান তখন তিনি নিজেই তাদের কাছে দলের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। এতে তখন কিছুটা সফলও হয় দলটি। আর এ কারণেই কিছু প্রভাবশলী দেশ বিএনপির দাবি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে কথা বলে। এক পর্যায়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকিয়ে দেবে বলে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের আশ্বাসে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কৌশল জোরদার করে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে সক্ষম হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে আবারও কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে বিএনপি কিন্তু কূটনীতিকরা বিএনপিকে আশার বাণী শোনানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। প্রতিটি দেশের কূটনীতিকরাই বিএনপিকে বলেছেন সরকারী দলের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপের চেষ্টা করা হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৫ বছর মেয়াদ শেষে পরবর্তী যে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সংলাপ হতে পারে। সরকারী দলের এ অবস্থানের কারণে নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের আগে সংলাপ করতে চেয়েও পারেনি বিএনপি। তবে বিএনপি সার্চ কমিটি গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে দলীয় প্রস্তাব দিয়েছে। সূত্রমতে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা না থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও নতুন উদ্যমে চেষ্টা চালিয়ে দেখতে চায় বিএনপি হাইকমান্ড। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর আগে ২০১২ সালে (২৮ অক্টোবর থেকে ৩ নবেম্বর) ভারত সফরে গেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কথা বলা হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া সে পরামর্শ গ্রহণ না করায় তার প্রতি ভারতের বিভিন্ন মহল নাখোশ হয় বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। তবে যুদ্ধাপরধের বিচারে জামায়াতের প্রভাবশালী নেতাদের ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় এখন জামায়াতের প্রতি ভারতের সেই কঠোর অবস্থান নাও থাকতে পারে বলে বিএনপির কোন কোন নেতা মনে করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ভিশন-২০৩০ ঘোষণার পর নতুন উদ্যমে দলের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আর এ জন্যই আপাতত আন্দোলনের পরিবর্তে ইতিবাচক কর্মসূচীর দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের মানুষ বর্তমান সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। একবার নির্ভয়ে ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে তারা বিএনপির পক্ষে রায় দেবে। আর বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে কোথায় নিয়ে যেতে চায় তা জানানোর জন্যই ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করা হয়েছে। আর এ ভিশনকে শুধু দেশের মানুষই নয়, বিদেশীরাও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে সব সময়ই বিএনপি সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে, ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক আরও জোরদার করা হবে।
×