ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দীপ্তি মিত্র, নাইজিরিয়া থেকে

নাইজিরিয়ার পথে পথে

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ১৯ মে ২০১৭

নাইজিরিয়ার পথে পথে

নাইজিরিয়ায় এসেছি ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে। তখন থাকতাম ‘মাইডুগুরি’ প্রদেশে। এখন ‘কানো’ প্রদেশে। এখানকার আবহাওয়া খুবই উষ্ণ। বিশেষ করে মে, জুন ও জুলাই মাসে অসহনীয় গরম পড়ে এখানে। কোন কোন সময় তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী ছাড়িয়ে যায়। গরমে ঠোঁট আর পা ফেটে যায়। এমনকি চিনি পরে থাকলেও সেখানে পিঁপড়া আসে না। এখানকার রাস্তাগুলো ওয়ানওয়ে। বেশ চওড়া। রাস্তার দুই পাশে অনেক জায়গা আর বড় বড় গাছ। যা সাধারণত বাংলাদেশের হাইওয়েতে দেখা যায় না। এদেশে বাড়িগুলো অনেক বেশি জায়গা নিয়ে তৈরী। একটা বাড়ির কম্পাউন্ডে এত জায়গা থাকে যে, সেখানে আরও পাঁচটা বাড়ি বানানো যায়। বেশিরভাগ বাড়িই বাংলো টাইপের। ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। কোন বাড়িতেই ছাদ নেই। অনেকটা ইউরোপ স্টাইলে। এখানে রাস্তায় পলিথিনে করে আপেল, আঙুর বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া গেলেও সব ধরনের সবজি পাওয়া যায় না এদেশে। চার-পাঁচ প্রকার মাছ পাওয়া যায়। আম এ দেশের জনপ্রিয় ফল। সুযোগ পেলেই আমরা আম বাগানে যাই, আর নিজের হাতে আম পাড়ি। এ দেশে না এলে চেরি আর আলফ্রান্সো আমের স্বাদ কোনদিনও বুঝতে পারতাম না। ‘বাবু’ শব্দ টার মিনিং এখানে ‘নেই’। কেউ যদি বলে ‘বাবু’, তার মানে সে বুঝালো তার কাছে ওই জিনিস নেই। সাধারণত বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও নামের আগে ‘বাবু’ বলা হয়। যেমন ‘বাবু রতন’। আর এরা বলবে ‘আলহাজী রতন’। বাঙালীদের জন্য এখানে ভ্রমণের জায়গা খুব কম। মাঝে মাঝে শহর থেকে একটু দূরে লেক বা ড্যাম এ ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয়। ওখানে গেলে দেখা যায় নৌকা করে মাঝি মাছ ধরছে। সেখান থেকে ফ্রেশ মাছ কেনা যায়। পাবদা আর রেড টেইল মাছ বেশি পাওয়া যায়। রেড টেইল মাছ দেখতে আমাদের দেশের পুঁটি মাছের মতো। টেইল মাছ একদম লাল। এ দেশের রাস্তাঘাটে বহু ভিক্ষুক দেখা যায়। তবে বাচ্চারাই বেশি ভিক্ষা করে। এখানে সজনে ডাটার বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্য করেছি। নাইজিরিয়ানরা সজনে ডাটা না খেয়ে, ওই গাছের পাতা খায়। শুনেছি ওই পাতা দিয়ে ওরা স্যুপ বানিয়ে খায়। এমন কি ঘাস ফড়িং ভাজাও বাজারে কিনতে পাওয়া যায়! নাইজিরিয়ার বেশ কিছু শব্দ খুবই মজার। তেমনই একটি শব্দ ‘অগা’। এখানে অগা মানে বড় ভাই বা বস। ছোটবেলায় বন্ধুরা কেউ কিছু সহজে না বুঝলে বলতো ‘তুই একটা অগা’। এই শব্দের অর্থ জেনে খুবই অবাক হয়েছিলাম। আর এ কথা চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম এক বাংলাদেশী বন্ধুকে। নাইজিরিয়ায় প্রায়ই বালু ঝড় হয়। এই ঝড়কে হারমাটন বলে। বলার সময় র’টা সাইলেন্ট থাকে। এই ঝড়ে চারদিক বালুময় হয়ে পড়ে। এ ঝড় এতই তীব্র যে, ঘরের জানালা লাগানোরও সময় পাওয়া যায় না। এখানে এক ধরনের খাবার পাওয়া যায়, যা নাইজিরিয়ান ভাষায় ‘চিকেন সুইয়া’। এখানকার লোকাল অনেক খাবারই বাঙালীদের জন্য খাওয়া কষ্টকর। কিন্তু এই চিকেন সুইয়া খেতে বেশ সুস্বাদু। শুধু ইয়াজি মসলা আর তেল দিয়ে কয়লার আগুনে মুরগিকে পোড়ানো হয়। আর এভাবেই তৈরি হয় চিকেন সুইয়া। ইয়াজি হচ্ছে আদার গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া আর বাদাম গুঁড়ার মিশ্রণ। সুইয়ার সঙ্গে মাচাও দেয়। মাচা আমাদের দেশের সাজের পিঠার মতো দেখতে। কিন্তু স্বাদ ভিন্ন। চালের গুঁড়া দিয়ে বানায়। তেল দিয়ে ভাজা হয়। খেতে হালকা মিষ্টি। এ দেশে সবকিছুর দাম খুব বেশি। কারেন্সি ভ্যালু কম। প্রথম দিকে ১০০ ন্যায়রাতে (নাইজিরিয়ার মুদ্রা) এক ডলার পাওয়া যেত। এখন পাঁচশ’ ন্যায়রাতে এক ডলার পাওয়া যায়। তবে এই ন্যায়রার মূল্যমান এক সময় অনেক ছিল। শুনেছি, আগে নাকি ইউনিভার্সিটির ডিনদের বেতন ছিল সাতশো ন্যায়রা। আর এখন একটা ফুলকপি কিনতে লাগে পাঁচশ’ ন্যায়রা! এখানকার স্থানীয় বাজারে কোন পণ্য কেজি হিসেবে বিক্রি হয় না। ওরা মুডু আকারে বিক্রি করে। এই মুডু ভিন্ন ভিন্ন আকারে হয়। যেমন এক মুডু চাল, দুই মুডু পিঁয়াজ এভাবে। এই মুডু প্লাস্টিক, বাঁশ বা এলুমিনিয়াম দিয়ে তৈরী। মশার জন্য বিখ্যাত নাইজিরিয়া! এই মশার সাইজ দেখলে যে কেউ অবাক হবেন। ম্যালেরিয়া এখানে স্বাভাবিক রোগ। প্রতিবছর গরমে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া হলে এরা ইনজেকশন নিয়ে নেয়। ব্যাস, ঝামেলামুক্ত! এখানে পানি আর বিদ্যুতের খুবই অভাব। বিদ্যুতকে নাইজিরিয়ানরা ‘নেপা’ বলে। সবসময় পানি পেতে হলে নিজস্ব বোরহোল (মাটির নিচ থেকে পানি উঠানোর ব্যবস্থা) থাকাটা জরুরী। না হয় পানির সঙ্কট পোহাতে হবে। তবে রাস্তায় রাস্তায় গ্যালোন ভর্তি পানি কিনতে পাওয়া যায়। এগুলোকে ময়া বলে। সারাদিন বিদ্যুৎ পেতে হলে জেনারেটর আর ইনভেটর থাকতে হবে। নাইজিরিয়ানরা ভাতের সঙ্গে স্যুপই বেশি খায়। এই স্যুপ অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন ইয়াম স্যুপ, লাল মরিচের স্যুপ, বিনস স্যুপ। পাস্তা, ম্যাকারনি, ম্যাগি খুব প্রিয় তাদের। এখানে অনেক বড় তেলেপিয়া মাছ পাওয়া যায়। এগুলো আগুনে পুড়িয়ে খায় এরা। ব্রেড এদের কমন খাবারের একটা। এখানকার মেয়েরা যে জামা পরে তার নাম ‘রাপা’। এই রাপার সঙ্গে মাথায় প্যাঁচানোর জন্য ম্যাচিং কাপড় বা ওড়না থাকে। পুরুষরা এক ধরনের লম্বা আর ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি পরে। এই পাঞ্জাবির দুই দিকে বেশ খানিকটা অতিরিক্ত কাপড় থাকে। যেটা ওরা কাঁধের ওপর ফেলে রাখে। ‘ফাতিমা’ আর ‘মোহাম্মদ’ খুবই কমন নাম এখানকার মানুষের। এ ছাড়া দিনের নামেও এদের নাম হয়। যেমন সানডে, মানডে। মাইডুগুরিতে স্থানীয় বাজারের নাম ‘মানডে মার্কেট’। খুব সুন্দর সুন্দর ইংরেজি নামও শোনা যায়। যেমন : পেসেন্স, পিস, কমফোর্ট, স্টার, ফ্লোরেন্স ইত্যাদি। ‘মেরি’ নামটাও অনেক কমন এখানে। খুব ভাল সোনা পাওয়া যায় নাইজিরিয়ায়। একদম খাঁটি সোনা যাকে বলে। বেশিরভাগ সোনাই দুবাই অথবা সৌদি থেকে আসে। আর চোখ জুড়ানো সব ডিজাইন। স্পেশালি চুড়ির ডিজাইন। কিন্তু কোন শপিং মলে সোনার দোকান নেই। সোনা কিনতে হলে সাবোংগাড়িতেই যেতে হবে। ‘সাবোংগাড়ি’ হচ্ছে এখানকার লোকাল মার্কেটের নাম। নাইজিরিয়ায় বাংলাদেশীর সংখ্যা খুবই কম। ইন্ডিয়ান আর লেবানিস প্রচুর। লেবানিসদের জন্য রয়েছে আলাদা স্কুল। নাম ‘লেবানন স্কুল’। বাংলাদেশের রিকশার মতো এখানেও এক সময় ভাড়ায় বাইক চলতো। অবশ্য এখন বাইক সার্ভিস বন্ধ। এখন ভাড়ায় চালিত হলুদ অটো দেখা যায়। এরা এই অটোকে ‘কেকে’ বলে। আর বাইক কে বলে ‘অকাডা’। সবাই এখানে ইংরেজী ভাষায় কথা বলে। কাজের মেয়ে, ড্রাইভারও ইংরেজীতে কথা বলে। তবে এদের ভিন্ন ভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন ভাষা রয়েছে। একটা লোকাল ভাষার নাম হচ্ছে ‘হাউসা’। হাউসাতে পানিকে ‘রোয়া’ বলে। আসাকে ‘যো’ বলে। যাওয়াকে বলে ‘ইয়াতাফি।’ একটু গ্রামের দিকে গেলে অনেক ছোট ছোট ঘর দেখা যায়। সেগুলো মাটি দিয়ে বানানো। কুঁড়েঘরের মতো দেখতে। এখানকার মহিলারা ছোট বাচ্চাদের পিঠে বেঁধে রাখে। পিঠে বাচ্চা নিয়েই সব কাজ অনায়াসে করে ফেলে। আবার পিঠেই বাচ্চা খুব আরামে ঘুমিয়ে যায়। অনেকটা আমাদের দেশের পাহাড়ী মেয়েদের মতো। নাইজিরিয়াতে প্রায় দশ বছর আমার। খারাপ লাগছে না এ দেশ। এখানকার মানুষ খুবই পরোপকারী। আর বিদেশীদের এরা সম্মানও করে। এখানে অচেনা মানুষকে সবাই শুভেচ্ছা জানায়। হতে পারে এটা ‘সুপ্রভাত’ অথবা ‘শুভসন্ধ্যা’। এখন পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি আমাকে। ভালই ভালই কেটেছে দশটি বছর। বলা যায় নাইজিরিয়াই আমার সেকেন্ড হোম।
×