ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

২৫ সিন্ডিকেট সক্রিয়

চোরাচালানের অবৈধ সোনাই মার্কেটে গিয়ে বৈধতা পাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ মে ২০১৭

চোরাচালানের অবৈধ সোনাই মার্কেটে গিয়ে বৈধতা পাচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ দেশের ভেতরে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার চোরাচালানের অবৈধ সোনা ঢুকছে। এগুলোই সোনার বাজারে চলে গিয়ে বৈধ হয়ে যাচ্ছে, যা ওপেন সিক্রেট। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রয়েছে সোনা চোরাচালানের অন্তত ২৫ সিন্ডিকেট। সোনা চোরাচালানের রাঘব বোয়ালরা কখনও ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে বাহক। সোনা চোরাচালানিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকায় প্রকৃত চোরাচালানিরা ধরা পড়ে না। এই প্রভাবশালী চোরাচালান সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে দেশের সোনার বাজার। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সিন্ডিকেটের লোকজন নিত্য অবৈধ স্বর্ণ আনছে দেশে। তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সেক্টরের আড়াইশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী সহায়তা করছে এ সোনা চোরাচালানি সিন্ডিকেটকে। দেশের বড় বড় সোনার দোকানির কাছে হাতবদল হয়ে চলে আসে সোনার বাজারে। আপন জুয়েলার্সের শোরুমে অভিযান চালিয়ে কাগজপত্রবিহীন অবৈধ সোনা ও ডায়মন্ড সাময়িক আটকের পর সোনা চোরাচালানের ঘটনা এখন আবার সামনে এসেছে। বর্তমানে সোনা ও ডায়মন্ড আমদানি হয় না, যা চোরাচালান নির্ভর বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বর্ণ চোরাচালান সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। সরকারের নীতি নির্ধারক মহল থেকে গোয়েন্দা সংস্থা সোনা চোরাচালানিদের ওপর কঠোর নজরদারির পর থেকে মাঝে মধ্যেই সোনার বড় বড় চালান ধরা পড়ছে। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে দুই-চার কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা এখন আর এগুলো কোন খবরই নয়। কারণ এ ধরনের খবর এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে অনেকটাই। বড় চালান ধরা পড়লেই কেবল আলোচনা হয়, হৈচৈ পড়ে যায়। দেশে কত সোনার চোরাচালান আসে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে কত সোনা ধরা পড়ছে তার পরিসংখ্যান আছে। সোনার চোরাচালান ও চোরাচালানিরা ধরা পড়ার পরিসংখ্যান দিয়েই সোনা চোরাচালানের হিসাব-নিকাশ করা হয়। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরেরও কম সময়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর উদ্ধার করেছে এক টনেরও বেশি স্বর্ণ। এসব স্বর্ণের দাম ৫২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। উদ্ধার করা এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করা হয়। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের হিসাব মতে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫১.৫৪ কেজি স্বর্ণ যার দাম ৬৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা স্বর্ণের পরিমাণ ৬৪১.৯০৮ কেজি যার দাম ৩০১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা স্বর্ণের পরিমাণ ২০৩.৫৪ কেজি যার দাম ৯৮ কোটি এক লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার করা স্বর্ণের পরিমাণ ৬৯.২৪ কেজি যার দাম ৩৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত উদ্ধারকৃত স্বর্ণের পরিমাণ ৮৫.৯৮ কেজি যার দাম ১৯ কোটি এক লাখ টাকা। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সোনা চোরাচালানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানে ১৮, শাহ আমানতে ৫ ও ওসমানী বিমানবন্দরে দুটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিমানবন্দর ও বিমানে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে তারা চোরাচালান করছেন। এসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে রয়েছেন বিমান বাংলাদেশের কয়েকজন পাইলট, কো-পাইলট, কেবিন ক্রু, ফ্লাইট স্টুয়ার্ট, চিফ পার্সার, জুনিয়র পার্সার ছাড়াও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতি দশ তোলা স্বর্ণ বিমানবন্দরের ভেতর থেকে বাইরে আনতে জনপ্রতি দেয়া হচ্ছে দেড় হাজার টাকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতীয় চোরাচালান প্রতিরোধ-সংক্রান্ত কমিটির সভায়ও সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান বন্ধ ও বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট সম্পর্কে আলোচনা হয়। সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, স্বর্ণ চোরাচালানে গ্রেফতার ব্যক্তিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে জড়িত মূলহোতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সকল সংস্থার সদস্যদের নির্ধারিত সময়ের পর গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের বিবরণসহ নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, দেশের সোনার চাহিতা মিটিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বর্ণালঙ্কারের চাহিদা মেটাতে সোনার বার দুবাই, মালয়েশিয়া, ওমান, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। এসব বার পরে বেনাপোল স্থলবন্দর ও ভোমরা স্থলসীমান্ত দিয়েও পাচার করা হয়। এসব সোনার চালানের মধ্যে খুব সামান্যই ধরা পড়ে। চোরাচালান চক্রগুলোর মধ্যে দেশে অবস্থান করা চক্রগুলো সরাসরি জড়িত থেকে মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে, মানি চেঞ্জারের ব্যবসার আড়ালেও স্বর্ণ চোরাচালান করছে। সোনা চোরাচালানের অভিযোগে গত বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক এক উর্ধতন কর্মকর্তার আত্মীয় মাহমুদুল হক ওরফে পলাশ, বিমানের চিফ অব প্ল্যানিং এ্যান্ড সিডিউলিং ক্যাপ্টেন আবু মোহাম্মদ আসলাম শহীদ, ফ্লাইট সার্ভিস শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেন ও ব্যবস্থাপক (সিডিউলিং) তোজাম্মেল হোসেন এবং মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী হারুর অর রশিদ গ্রেফতার হন। এ ঘটনার পর দেশ থেকে পালিয়ে যান বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং শামীম নজরুল। তাদের অনেকই আইনের মারপ্যাঁচে ছাড়া পেয়েছেন। অনেকে বিদেশে পালিয়ে আছেন। শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, প্রায় প্রত্যেক মাসেই ৫-৬ অবৈধ সোনার চালান ধরা পড়েছে। তবে সম্প্রতি সোনার চোরাচালান ধরা পড়ায় এখন চোরাকারবারিরা কৌশল পরিবর্তন করায় তা কমে গেছে। এরপরও চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বড় ধরনের কয়েকটি চালান ধরা পড়ে। তবে বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তি ও পাচারকারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সোনা চোরাচালান ধরা পড়ে যায়। বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অসাধু কর্মীসহ একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি বিমানবন্দরে এক থেকে দেড় মণ চোরাই স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে, যাতে বিমানের উপমহাব্যবস্থাপকসহ একাধিক উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি আটক হন। সোনা চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
×