ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

বিশ্বের নাট্যাকাশে এশিয়ানসূর্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৮ মে ২০১৭

বিশ্বের নাট্যাকাশে এশিয়ানসূর্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবেই লিখে গেছেন, ‘আপন হ’তে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/বুকের মাঝে বিশ্ব লোকের পাবি সাড়া’। সাড়াতো মানুষ পেতেই চায় কিন্তু তার জন্য তো এমন আন্তরিক নির্দেশনা এবং সুযোগ মেলাটাও জরুরী। থিয়েটারের মানুষদের জন্য বিশ্বলোক না হোক এশিয়ালোকের একটা পারস্পরিক সমন্ধয়, চেতনার আদান-প্রদান এবং থিয়েটারের সুন্দর আগামী নির্মাণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল এশিয়ান থিয়েটার সামিট ২০১৭ আয়োজন উপলক্ষে। বিগত সময়ে প্রথমে কোরিয়া এবং তারপর জাপানে এ উৎসব উদযাপিত হলেও এবারকার তৃতীয়বারের মতো এ উৎসব উদযাপিত হলো ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যামেচার থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের (আইআট) এশিয়ান রিজিওনাল সেন্টারের উদ্যোগে। পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় গত ৫ ও ৬ মে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা, এক্সপেরিমেন্টাল হল, স্টুডিও থিয়েটার হল, মহড়াকক্ষ এবং সেমিনার কক্ষজুড়ে উদ্যাপিত হলো এশিয়ান থিয়েটার সামিট ২০১৭। সাত নৃগোষ্ঠীর নৃত্য পরিবেশনা দিয়ে শুরু হওয়ার পর পনেরো দেশের ২০ প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন এ্যাম্বাসির প্রতিনিধির মূল্যবান উপস্থিতি যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তা নিশ্চিত করলেন স্বাগত বক্তৃতায় এশিয়ানরিজিওনাল সেন্টারের প্রেসিডেন্ট এবং শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংযোগ দৃঢ়করণ, গবেষণার ক্ষেত্র বাড়ানো, প্রদর্শনীর বিনিময়করণ এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপারে অভীষ্ট লক্ষ্য নির্মাণই উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্য সেকথা ছিল তার বক্তব্যে। বক্তব্যে নাসির উদ্দীন ইউসুফের উচ্ছ্বাস, জীবন সুন্দর, নাটক জীবনকে করে আরও সুন্দর। সুন্দর, শুভ কাজে বিভেদের সীমারেখা সরিয়ে নেবার চ্যালেঞ্জও মোকাবেলার দায়িত্ব যে সকলের সে কথা দৃঢ় স্বরে বললেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতির বান্ধব, চায়নিজ অপেরা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সিঙ্গাপুরের চুয়া সু পং। সিঙ্গাপুর না বরং বিশ্ব আইটিআই এর সম্মানিক সভাপতি রামেন্দু মজুমদারের বিশ্বাস, উৎসবে উচ্চারিত পারস্পরিক সংলাপ যেমন পারে একদিকে দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, গোড়ামির বিরুদ্ধে লড়তে। অপরদিকে পরস্পরের কাছাকাছির আসার মধ্যে দিয়ে এক সাংস্কৃতিবান্ধব বিশ্বে পৌঁছে দিতে। পৌঁছাবার স্বার্থে উদ্বোধক এবং প্রধান অতিথি বাংলাদেশে সরকারের সংস্কৃতিক বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থিয়েটারে যত সমৃদ্ধ তাদের সম্পর্কে আমাদের জানাশোনাও তত কম। আমরা এ উৎসবে পরস্পরকে জানব, এশিয়ার থিয়েটারকে বিশ্বের সামনে এগিয়ে নেব। ভবিষ্যত এ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিবল করব। তথা উদীয়মান টাইগার হিসাবে বাংলাদেশ এশিয়ান নাটকের অগ্রযাত্রায় অগ্রণীর ভূমিকা পালন করবে। অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে তার প্রমাণ ছিল অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পরিকল্পনা ও বাস্তবতায়। দুদিনব্যাপী উৎসবে একদিকে ছিল এশিয়ার থিয়েটার চর্চা কেন্দ্রিক ভিন্ন ভিন্ন দেশের ৯টি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন, দেশকে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, লাউস, সিংঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্বদের অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান, ইন্টারন্যাশনাল এ্যামেচার থিয়েটার এ্যাওয়ার্ড প্রদান এবং সমস্ত সময় জুড়ে নান্দনিক শিল্পের উপস্থাপন। শিল্পের উপস্থাপনার ধারাবাহিকতা শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পর্বে সাত নৃগোষ্ঠীর নৃত্য পরিবেশনায়। চাকমা, গারো, ওরাও, মারমা, রাখাইন, বম ও ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর নৃত্য শিল্পীরা নৃত্য পরিবেশনায তুলে ধরেন প্রকৃতির সঙ্গে মানবের সম্পর্কের রসায়ন। গ্রীষ্মে পাখা, বর্ষায় ছাতা, লাঠির খেলা, ঝুড়িতে চা পাতা তোলা প্রভৃতি নৃত্য পরিবেশনায় যেভাবে জীবন ও প্রকৃতি ফুটে ওঠে তাতে বোঝা যায় এশিয়ায় যা যা আছে তার কম বেশি সবই আছে এই বাংলায়। বাংলায় কিংবা ফ্রান্সের পাশের ছোট্ট দেশ মোনকায়, ঘর যার যেখানেই হোক না কেন বাউল সুরে ‘বেঁধেছো এমনই ঘর শূন্যের ও মাঝারে...’ কিংবা শাহ আবদুর করিমের ‘কোন মিস্ত্রী নাও বানাইছে...’ গান কার না ভাল লাগে। ফলে সমীর বাউলের গায়কীতে সঙ্গ দিতে গিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের তাল-লয়-সুরে মিশে যাওয়া ছিল বাংলার লোক সাঙ্গীতের মাধুর্যের বিস্তৃততা। বিস্তৃত পরিধি আর গভীর দোতনায় মহাকালের রথ চক্র শুধুমাত্র রাজা, মন্ত্রী, সৈন্য কিংবা বণিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে চলে না। চলে সকলের সমবেত অংশ গ্রহণে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত, লিয়াকত আলী লাকী নির্দেশিত এবং লোকনাট্যদল পরিবেশিত ‘রথযাত্রা’ নাটক যেভাবে কোরিওগ্রাফির আদলে উপস্থিতি হয় তা ছিল প্রাণবন্ত।
×