ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৮ মে ২০১৭

চলে গেলেন কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের প্রখ্যাত কূটনীতিক, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, রাষ্ট্রদূত ফারুক চৌধুরী আর নেই। বুধবার ভোর চারটায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি কিছুদিন ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। বার্ধক্যজনিত জটিলতার পাশাপাশি হার্ট ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম সাবেক কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পৃথক শোকবার্তায় তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। সাবেক এই সচিব স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে, আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ও প্রিয়পাত্র ছিলেন। এদিকে বুধবার জোহরের নামাজের পর ফারুক আহমেদ চৌধুরীর মরদেহ তার একসময়ের কর্মস্থল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেয়া হয়। সেখানে একদফা জানাজার পর বাদ আসর ধানম-ি ৭ নম্বর রোডে বায়তুল আমান জামে মসজিদে আরেক দফা জানাজা হয়। পরে আজিমপুর কবরস্থানে বাংলাদেশের সাবেক এই কূটনীতিককে দাফন করা হয়। দেশের কূটনীতিক মহলে তিনি ফারুক চৌধুরী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিবের পুরো নাম ফারুক আহমেদ চৌধুরী। ১৯৩৪ সালের ৪ জানুয়ারি ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ফারুক চৌধুরী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে সার্কের জন্মলগ্নে প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যে লেখাপড়া করার পর তিনি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তান ফরেন অফিস ও মিশন বোর্ডে কাজ করেন। কর্মজীবনে তিনি ইতালি, চীন, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, আবুধাবি এবং ভারতে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম চীফ অব প্রটোকল হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭২-৭৬ সাল নাগাদ তিনি যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশের কমনওয়েলথভুক্ত হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৬-৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং ১৯৭৮-৮২ সাল নাগাদ তিনি ইইসি ও বেনেলাক্স দেশসমূহে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে সদর দফতরে ফিরে আসার পর তিনি ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৩তম ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩-৮৪ তিনি অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮৪ সালে তিনি পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সাল নাগাদ তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৬-৯২ সাল নাগাদ তিনি ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিযুক্ত হন। ১৯৯২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি সমাজসেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় অনেকগুলো বই লেখেন। ফারুক চৌধুরী বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এনজিও বাংলাদেশ রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্রাক)-এর বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বও পালন করেন। ব্র্যাক পরিচালনা পর্ষদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। এ ছাড়া বেসরকারী গৃহায়ন প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও পরে তিনি কয়েক বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ছিলেন ফারুক চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব ঘনিষ্ঠ ও প্রিয়পাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে তার বিভিন্ন সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন ফারুক আহমেদ চৌধুরী। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পথে দিল্লীতে বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে বঙ্গবন্ধু ইংরেজীতে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। ফারুক চৌধুরীই ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইংরেজীতে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে গত বছর অক্টোবরে একটি পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধুর যে সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন একজন সাধারণ কূটনীতিবিদের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে তা ছিল বিরল সৌভাগ্য। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সেই সান্নিধ্যের খেসারত তাকে দিতে হয়েছিল। ওই সাক্ষাতকারে ফারুক চৌধুরী বলেন, লন্ডনের মিশনে দায়িত্ব পালন শেষে তাকে দেশে ফিরতে বলা হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ওই বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। ফলে একটি বছর তার অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটে। সে সময় তার পদমর্যাদাও নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে ফারুক চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। বাকি তিন ভাইয়ের মধ্যে সাবেক সচিব ইনাম আহমেদ চৌধুরী বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন একসময়। আর এক ভাই সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুম আহমেদ চৌধুরী ২০১২ সালে মারা গেছেন। বোনদের মধ্যে নাসিম হাই শহীদ কর্নেল সৈয়দ আবদুল হাইয়ের স্ত্রী। ছোট বোন নীনা আহমেদের স্বামী ফখরুদ্দীন আহমেদ ২০০৭-০৮ সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। বর্তমানে তারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। ফারুক চৌধুরী ও তার স্ত্রী জিনাত চৌধুরীর দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ছেলে আদনান চৌধুরী ব্যবসা করেন। মেয়ে ফারজানা আহমেদ অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। অবসরের পর ফারুক চৌধুরী বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে যুক্ত হন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পায়। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ছাড়াও আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার পান তিনি। তার লেখা অন্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে দেশ দেশান্তর, প্রিয় ফারজানা, নানাক্ষণ নানা কথা, স্বদেশ স্বকাল স্বজন। এ ছাড়া পত্রপত্রিকায় আন্তর্জাতিক, কূটনীতিসহ নানা বিষয়ে লেখালেখি করতেন।
×