ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ছড়াচ্ছে চিকুনগুনিয়া, উপসর্গগুলো ডেঙ্গুর মতোই

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ মে ২০১৭

ছড়াচ্ছে চিকুনগুনিয়া, উপসর্গগুলো ডেঙ্গুর মতোই

ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ গত কয়েক মাস ধরে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ ভাইরাস জ্বর মনে হলেও রোগটি আসলে চিকুনগুনিয়া। লক্ষণগুলো ডেঙ্গু জ্বরের মতোই। অনেক রোগীই প্রায়ই অভিযোগ করছেন, তাদের ভাইরাস জ্বর বা ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল, কিন্তু জ্বর সেরে গেলেও শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। যে কোন ভাইরাস বা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়। অথচ দেখা যাচ্ছে, জ্বর ছেড়ে গেলেও রোগী আরও কিছুদিন অসুস্থ ও দুর্বল বোধ করছেন, বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন গিটে গিটে ব্যথা কিছুতেই যাচ্ছে না বা দুর্বলতা, ক্লান্তি কাটছে না। আসলে ডেঙ্গু হিসেবে সন্দেহ করা হলেও এ রোগটি সম্ভবত ডেঙ্গু জ্বর নয়, বরং অন্য একটি ভাইরাসজনিত রোগ যাকে বলে চিকুনগুনিয়া। চিকুনগুনিয়া কী? চিকুনগুনিয়া রোগটি ভাইরাসজনিত। শব্দটি আফ্রিকান যার অর্থ ‘ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া।’ এই রোগটির প্রাদুর্ভাব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশে বেশি হলেও আমাদের দেশের কিছু কিছু এলাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের অতি পরিচিত ডেঙ্গুর সঙ্গে এর অনেকটাই মিল রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের মতোই এই ভাইরাসটি এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস এ্যালবোপিক্টাস মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। চিকুনগুনিয়া মানবদেহ থেকে মশা এবং মশা থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে থাকে। মানুষ ছাড়াও বানর, পাখি, তীক্ষè দন্তপ্রাণী যেমন ইঁদুরে এই ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান। লক্ষণ সমূহ চিকুনগুনিয়ার মূল উপসর্গ হলো জ্বর এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা। জ্বর অনেকটা ডেঙ্গু জ্বরের মতোই। দেহের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠে যায়, তবে কাঁপুনি বা ঘাম দেয় না। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালা করা, গায়ে লাল লাল দানার মতো র‌্যাশ, অবসাদ, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, এমনকি ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সাধারণত ২ থেকে ৫ দিন থাকে এবং এরপর এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। তবে তীব্র অবসাদ, পেশিতে ব্যথা, অস্থিসন্ধির ব্যথা ইত্যাদি জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি মাসের পর মাসও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা বা প্রদাহ থাকতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক কাজ করতে অক্ষম করে তোলে। রোগী ব্যথায় এতই কাতর হয় যে হাঁটতে কষ্ট হয়, সামনে বেঁকে হাঁটে। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও তাই একে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ বলা হয়। বয়ষ্ক রোগীদের রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হয় এবং উপসর্গগুলো বিশেষ করে শরীর ব্যথাও বেশিদিন থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের সঙ্গে পার্থক্য ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সাধারণত এত দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ব্যথা বা অন্য লক্ষণগুলো থাকে না। যদিও জ্বর ভাল হয়ে গেলে কয়েকদিন দুর্বলতা বা ক্লান্তি লাগতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মূল সমস্যা হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ, যা অনেক সময় খুব ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু চিকুনগুনিয়া জ্বরে ডেঙ্গুর মতো রক্তক্ষরণ হয় না এবং রক্তের প্লাটিলেট সাধারণত খুব বেশি কমে না। এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ মারা যায় না, শুধু দীর্ঘদিনের জন্য অনেকেই স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে চারবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিকুনগুনিয়া সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এক্ষেত্রে রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে ২ থেকে ১২ দিন লাগতে পারে। আরটি-পিসিআর এবং সেরোলজির মাধ্যমে পরীক্ষাগারে ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে শুধু শুধু এই পরীক্ষা করার কোন দরকার নাই, কেননা এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন লাভ হবে না। চিকিৎসা অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতো এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলোকে নিরাময় করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল পদার্থ খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট, এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য অন্য ভাল ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে, তবে এসপিরিন না দেয়াই ভাল। ক্লোরোকুইন এই রোগের উপশম করে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন। রোগীকে আবার যেন মশা না কামড়ায় এজন্য তাকে মশারির ভেতরে রাখাই ভাল। কারণ আক্রান্ত রোগীকে মশায় কামড় দিয়ে কোন সুস্থ লোককে সেই মশা কামড়ালে ওই ব্যক্তিও এই রোগে আক্রান্ত হবেন। প্রতিরোধ চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোন প্রতিষেধক নেই, কোন ভ্যাক্সিন বা টিকাও নেই। তাই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। এডিস মশার উৎপত্তি স্থল ধ্বংস করা এবং মশাকে নির্মূল করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাসাবাড়ির আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ডাবের খোসা, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব এসব স্থানে যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মজা পুকুর বা ডোবা পরিষ্কার করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের বেলায় স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে, কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় মশা নোংরা অপরিষ্কার পানিতেও ডিম পাড়তে পারে। তাই পানি জমে থাকে এমন সকল স্থান পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়া মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরে ঘরে মশার ওষুধ দেয়া, দরজা জানালায় নেট লাগানো, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার, লম্বা হাতলযুক্ত জামা ও ট্রাউজার পরে থাকা উচিত। বাইরে যাওয়ার সময় শরীর ভালভাবে ঢেকে রাখতে হবে যাতে মশা কামড়াতে না পারে। তবে জেনে রাখা ভাল এডিস মশা মূলত দিনের বেলা এবং ঘরের বাইরেই বেশি কামড়ায়। রোগটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকলে তা থেকে আমাদের নিরাময় পেতে সুবিধা হয়। জেনে নিন চিকুনগুনিয়া রোগ সম্পর্কে কিছু টিপস : ১. চিকুনগুনিয়া রোগটি এডিস মশার কামড় থেকেই হয়। তাই মশা থেকে দূরে থাকুন। ২. সন্তান মায়ের স্তন্য পান করলে সাধারণত চিকুনগুনিয়া হয় না। তাই আক্রান্ত মায়েদের চিন্তিত হওয়ার তেমন কোন কারণ নেই। ৩. চিকুনগুনিয়া হয়েছে এটা বোঝার উপায় হলো জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা, সারা শরীরে ব্যথা এবং গিরায় গিরায় খুব বেশি ব্যথা হয়। ডেঙ্গুর মতোই গায়ে এলারজি বা ঘামাচির মতো র‌্যাশ হয়। তবে রক্তক্ষরণ একেবারেই হয় না, রক্তের প্লাটিলেটও কমে না, রক্ত দেয়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না। ৪. ডেঙ্গুর চিকিৎসা এবং চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা প্রায় একই রকম এবং এতে রোগীর কোন সমস্যা হবে না। বরং ভাইরাস সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে গেলে যেসব ব্যয় বহুল পরীক্ষা করতে হবে তা অনেক দরিদ্র রোগীই করতে পারবেন না, তার প্রয়োজনও নেই। এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও কোন অতিরিক্ত সুফল পাওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে রোগটি নতুন হলেও এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এতে কেউ মারা যায় না। হয় তো বা কিছুদিন ভোগান্তি বাড়ায়। একটু সচেতন হলেই এ রোগ মোকাবেলা করা সম্ভব। ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
×