ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দলের ভেতরের ষড়যন্ত্র সুযোগ করে দেয় হত্যাকারীদের

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৮ মে ২০১৭

দলের ভেতরের ষড়যন্ত্র সুযোগ করে দেয় হত্যাকারীদের

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের জন্য দলের ভেতরের মানুষদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করে বলেছেন, এ হত্যাকা-ে খন্দকার মোশতাক, জিয়াসহ অনেকে জড়িত ছিল। আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। সে সুযোগটা (তারা) করে দিয়েছিল। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই নিয়মিত ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর নিজের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বুধবার গণভবনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফুল-শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় প্রধানমন্ত্রী দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র এখনও আছে। তবে কোন ষড়যন্ত্রের পরোয়া না করেই জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাবেন তিনি। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি এসব ষড়যন্ত্র দেখে আসছি। জীবন-মৃত্যু আমি পরোয়া করি না। মৃত্যুকে আমি সামনে থেকে দেখেছি। আমি ভয় পাই না। আমি বিশ্বাস করি যতদিন মহান আল্লাহ এবং বাংলার জনগণ তাঁর পাশে রয়েছেন, মা-বাবার দোয়া ও আশীর্বাদ রয়েছে ততদিন এই লক্ষ্য অর্জনকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। দীর্ঘ ৫২ মিনিটের বক্তব্যে রাখতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। নিজে কেঁদেছেন, কাঁদিয়েছেন সবাইকে। আবেগাপ্লুত হয়ে বক্তব্যের মধ্যে অনেকবারই থেমে গেছেন। চোখ মুছতে মুছতে আবার কথা বলেছেন। স্মৃতিচারণ করেছেন নির্বাসনের সেই কষ্টের দিনগুলোর সময়লিপি। বলেছেন কাছের মানুষদের ষড়যন্ত্র, অনেকের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের নির্মমতা, দেশে ফিরে আসার পর সংগঠনের বিভক্তি, সংগঠন গোছানো, দেশের মানুষের কাছে যাওয়া, নানা প্রতিবন্ধকতা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের কথা। বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব খুঁজে নেয়ার কথা বললে হলভর্তি শত শত নেতাকর্মী সমন্বরে ‘নো নো’ বলে তাঁর প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় শেখ হাসিনাকে আনতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রত্যয়সহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩৬তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৬তম বর্ষপূর্তি দিবসে সর্বস্তরের মানুষের প্রাণঢালা ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর শুভেচ্ছায় স্নাত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দিবসটি পালনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, শেখ হাসিনার সুন্দর জীবন ও দীর্ঘায়ু কামনা করে দেশব্যাপী দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আনন্দ শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বুধবার সকাল থেকে গণভবনে ছিল নেতাকর্মীদের ভিড়। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ফুলের তোড়া দিয়ে তাঁকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের শুভেচ্ছা জানান। এ সময় দেশে ফিরে আসাটা তাঁর জন্য কতটা কঠিন ছিল তা উঠে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবেগঘন বক্তৃতায়। ফিরে এসে দলের দায়িত্ব নেয়া তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল বলেও জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরবর্তী কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে এতবড় দায়িত্ব আমাকে তারা দিয়েছিলেন। সেদিন মানুষের যে ঢল নেমেছিল সেই কারণেই তখন জিয়াউর রহমান আমাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারেনি। নইলে আমি ফেরত আসতে পারতাম না। এমনকি ফিরে আসার পর আমাকে ধানম-ি ৩২ এ যেতে দেয়নি এবং মিলাদও পড়তে দেয়া হয়নি। আমাকে বলা হয় অন্য একটা বাড়ি আমাদের দেবে। আমি বলেছিলাম কোন বাড়ির লোভে আমি আসিনি। তিনি বলেন, এত বড় সংগঠন করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আমার চলার পথ অত সহজ ছিল না। তখন খুনীরা বহাল তবিয়তে বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত। স্বাধীনতা বিরোধীরা তখন বহাল তবিয়তে। তারাই ক্ষমতার মালিক। যে পরিবারকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সে পরিবারের একজন এসে রাজনীতি করবে; সেটা এত সহজ ছিল না। তখন প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা ছিল। দেশের জনগণের উপর বিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার কথা ভাবতেও পারেনি উল্লেখ করে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা বলেন, অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিলেন; আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু জাতির পিতা বিশ্বাসই করেননি। আব্বা বলতেন, ‘না ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কে মারবে? পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসররাই জাতির জনককে হত্যা করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই হত্যাকা-ে যারা জড়িত ছিল, তাদের অনেকেই নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসত। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুনী ডালিম (শরিফুল ইসলাম ডালিম), ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালী ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসায় পড়ে থাকত। ডালিমের শাশুড়ি তো সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত, ডালিমের বউ তো সারাদিনই আমাদের বাসায়।’ খুনী মেজর নূর চৌধুরীর নিজের ভাই শেখ কামালের সঙ্গে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা তো অত্যন্ত চেনা মুখ। আরেক খুনী সৈয়দ ফারুক রহমান বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিকের শালীর ছেলে। খুব দূরের না। কিন্তু এরাই ষড়যন্ত্র করল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এভাবে বেঈমানি করে, মোনাফেকি করে, তারা কিন্তু এভাবে থাকতে পারে না। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করে। তাদের মধ্যে অবশ্যই যোগসাজশ ছিল। জিয়ার পারিবারিক সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ নেয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান প্রতি সপ্তাহে একদিন তার স্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) নিয়ে ওই ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দুয়ার সবার জন্য অবারিত ছিল, যার সুযোগ ষড়যন্ত্রকারীরা নিয়েছিল। তাদের যাওয়াটা আন্তরিকতা, না চক্রান্ত করাটাই ছিল তাদের লক্ষ্য; সেটা বোধহয় আমরা বুঝতে পারিনি।’ তিনি বলেন, ‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আব্বা যখন দেখেছেন, তাঁকে গুলি করছে তারই দেশের লোক, তাঁর হাতে গড়া সেনাবাহিনীর সদস্য, তাঁর গড়া মানুষ; জানি না তখন বঙ্গবন্ধুর মনে কী প্রশ্ন জেগেছিল? একদিনে পরিবারের সবাইকে হারানোর দিনটি মনে করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, তখনও ততটা জানতে পারিনি কী ঘটে গেছে বাংলাদেশে। যখন জানতে পারলাম, তখন সহ্য করাটা কঠিন ছিল। ওই সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের পশ্চিম জার্মানির বন শহরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের কথা চেপে রাখার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকা- সম্পর্কে একটা কথাও বললেন না। উনার কোথায় যাওয়ার কথা ছিল চলে গেলেন। হুমায়ুন রশিদ সাহেব (সাবেক স্পীকার) এই হত্যাকা- সম্পর্কে কনডেম করলেন প্রেসের মাধ্যমে। ’ ভারতে নির্বাসিত জীবনের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভাবলাম দেশের কাজে যাই। কখনও শুনি মা বেঁচে আছেন। কখনও শুনি রাসেল বেঁচে আছে। একেক সময় একক খবর পেতাম। ওই আশা নিয়ে চলে আসলাম। কেউ বেঁচে থাকলে ঠিক পাব। ২৪ আগস্ট দিল্লী পৌঁছলাম। মিসেস গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদের ডাকলেন। ওনার কাছ থেকে শুনলাম, কেউ বেঁচে নেই। হুমায়ুন রশীদ সাহেব আগে বলেছিলেন। কিন্তু আমি রেহানাকে (শেখ রেহানা) বলতে পারিনি। কারণ ওর মনে একটা আশা ছিল, কেউ না কেউ বেঁচে থাকবে।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, দিল্লীতে যাওয়ার পর মিসেস গান্ধী আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওয়াজেদ সাহেবকে (ড. এম ওয়াজেদ মিয়া) এটমিক এনার্জিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘এটা কী কষ্টের-যন্ত্রণার, তা কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। অর্থের কারণে ১৯৭৭ সালে বোন শেখ রেহানার বিয়েতে লন্ডনে যেতে না পারার বেদনা তুলে ধরে তিনি বলেন, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাব, অত টাকা ছিল না। আর কোথায় পাব? ১৯৮০ সালে লন্ডনে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মিসেস গান্ধীকে গিয়ে বললাম, আমি যেতে চাই রেহানার কাছে। উনি ব্যবস্থা করে দিলেন। টিকেটের ও থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আবার ’৮০-এর শেষে দিল্লীতে ফিরে আসি। টাকাও ছিল না, আর কার কাছে হাত পাতাও ভাল লাগত না। এরপর মেয়ের হাত ধরে দুটা স্যুটকেস নিয়ে দেশে চলে আসি। আমি মনে করি, আমাকে যেতে হবে, কিছু করতে হবে।’ এভাবেই ৩৬ বছর আগের এই দিনটিতে দেশে ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত নেতাদের আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে বলেন শেখ হাসিনা; তবে সবাই সমন্বরে ‘না না’ বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘নতুন নেতৃত্ব খোঁজা দরকার। জীবন-মৃত্যু আমি পরোয়া করি না। মৃত্যুকে আমি সামনে থেকে দেখেছি। আমি ভয় পাই না। আমি বিশ্বাস করি, আমার আব্বা আমাকে ছায়ার মতো আমাকে দেখে রাখেন। আর উপরে আল্লাহ’র ছায়া আমি পাই। ফুল- শুভেচ্ছায় স্নাত শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সকাল থেকেই গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। প্রথমেই দলটির সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এরপর একে একে আওয়ামী লীগের সব সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছায় স্নাত করেন। দিবসটি উপলক্ষে সকালে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে। দুপুর ছাত্রলীগের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে এই শোভাযাত্রা শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ও আশপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়।
×