ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ পেতে ভোগান্তি ॥ নেট-পাটায় টিআরএম ভেস্তে যেতে বসেছে

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পে শম্বুকগতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ মে ২০১৭

প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পে শম্বুকগতি

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত আড়াইশ’ কোটি টাকার কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্পে প্রধান বাধা টিআরএম প্রকল্পভুক্ত জমির মালিকদের ফসলের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ভোগান্তি। ভূমি অধ্যাদেশ আইনের জটিলতাসহ জমির মালিকদের নাম পত্তনে জটিলতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বহুল আলোচিত কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্প। তথ্য মতে, ২০১১ সালে প্রকল্প কার্যক্রম শুরু থেকে প্রায় ৬ বছর পার হলেও জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে মাত্র ১ বছরের। পরের ক্ষতিপূরণ কবে দেয়া হবে তারও কোন পরিকল্পনা নেই। এদিকে পলি দ্বারা বিল ভরাটের মাধ্যমে টিআরএম বাস্তবায়ন প্রধান লক্ষ্য থাকলেও টিআরএমভুক্ত বিলে নেট-পাটা বসিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় টিআরএম প্রকল্প ভেস্তে যেতে বসেছে। টিআরএমভুক্ত জমির মালিকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও বিলের মধ্যে নেট-পাটার সমস্যাটি টিআরএম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা ও কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্পে প্রধান বাধা বলে এলাকাবাসী মনে করছেন। তবে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মোঃ মহিউদ্দিন প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিগ্রহণ করা জমির মালিকদের টাকা প্রদানের বিষয়টি প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন। তিনি এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, অধিগ্রহণ করা জমির মামলাগুলো জটিল। একটি জমির দাবিদার অনেক। মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধে সমস্যা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকৃত মালিক নিশ্চিত হওয়ার পর টাকা দেয়া হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কপোতাক্ষ নদের দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার এবং এর ক্যাচমেন্ট এরিয়া ১.০২ লাখ হেক্টর। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ এ নদের অববাহিকায় বাস করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কপোতাক্ষ অববাহিকার জলাবদ্ধতা শুরু হয় এবং ২০০০ সালের পর থেকে জলাবদ্ধতা স্থায়ী সমস্যা হিসেবে রূপ নেয়। পলি জমে কপোতাক্ষ নদ ভরাট হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত উপর্যুপরি বন্যা ও ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে জলাবদ্ধতা নিরসন ও কপোতাক্ষের বুকে জমা হওয়া পলি অপসারণের মাধ্যমে কপোতাক্ষকে রক্ষা করার জন্য জনগণ আন্দোলন শুরু করে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা দেন, তিনি নির্বাচিত হলে কপোতাক্ষ নদ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেবেন। এর ধারাবাহিকতায় মহাজোট সরকার ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চার বছর মেয়াদী কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পটি (প্রথম পর্যায়) অনুমোদন করে। প্রকল্পে নদটি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রধানত ২টি কাজ নির্ধারণ করা হয়। তালা উপজেলার জালালপুর ও খেশরা ইউনিয়নের পাখিমারা বিলে ১৫৬১.৯৬ একর জমির ওপর জোয়ারাধার স্থাপন করা এবং কপোতাক্ষ নদের ৯০ কিলোমিটার অংশ খনন করে জমে থাকা পলি অপসারণ করা। কিন্তু বাস্তবে এই কপোতাক্ষ খনন কাজ চলতে থাকে শম্বুক গতিতে। পাউবো ২০১৩ সালে পাখিমারা বিলের টিআরএমভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ২০১২ ও ২০১৩ সালের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আনুষঙ্গিক খরচসহ প্রাক্কলিত ব্যয়ের মোট ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৩০ হাজার ৬৮১.১৬ টাকা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে ৭ কোটি টাকা সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনকে প্রদান করা হয়। আর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ মে ১৭ পর্যন্ত ৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জমির মালিকদের পরিশোধ করা হয়। এ পর্যন্ত টিআরএমভুক্ত ৭৯২ জন জমির মালিক তাদের জমির ক্ষতিপূরণের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছেন। আর এই আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৫৭টি। অপেক্ষমাণ রয়েছে ১৩৫টি আবেদন। পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও এ পর্র্যন্ত জমির মালিকদের ১ বছরের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রায় অর্ধেক পরিশোধ করা হয়েছে। পাখিমারা বিলের জোয়ারাধারের জন্য ১৫৬১.৯৬ একর জমি হুকুম দখল করা হলেও নানা জটিলতার কারণে জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এর ফলে একদিকে বিল অধিবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অস্থায়ী মাইগ্রেশন হতে শুরু করেছে অন্যদিকে বিলের মধ্যে নেট-পাটা দিয়ে পলি ভরাটে চরম বাধা তৈরি করা হচ্ছে। এ কারণে জমির মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধিসহ নেট-পাটা ব্যবহারের কারণে সহিংস ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ছে। মূলত কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্প কাজের একটি মূল অংশ হলো পলিতে কপোতাক্ষের ভরাট হওয়া ৯০ কিলোমিটার খননের মাধ্যমে পলি অপসারণ করা। এর মধ্যে ভাটির দিকের ২৩ কিলোমিটার ড্রেজার দিয়ে এবং উজান এলাকার ৬৭ কিলোমিটার এক্সেভেটর দিয়ে খনন করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের প্রস্তাবনা অনুসারে নদীর ভাটির অংশের দিক থেকে নদী খনন শুরু না করে প্রথমে উজানের দিকের নদী খনন করা হয় এবং বার বার এলাকা প্লাবিত হওয়ার কারণে প্রকল্প মেয়াদের শেষে ২০১৫-১৬ সালে ভাটির অংশ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রায় ৪ বছর বিলম্বের কারণে ভাটির অংশে আরও পলি জমে ড্রেজার দিয়ে খননের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ কারণে এক্সেভেটর দিয়ে খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও যথাসময়ে কাজটি শেষ না হওয়ায় একদিকে যেমন অববাহিকার জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হয়নি তেমনি জনগণের ভোগান্তিও কমেনি। প্রকল্পের শুরুতেই পাখিমারা বিলে টিআরএম চালু করার কথা থাকলেও প্রায় ৪ বছর পর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তা চালু করা হয়। এর জন্য ১৯.৭৬ একর জমি স্থায়ীভাবে (অধ্যাদেশ-১৯৮২ অনুসারে) অধিগ্রহণ করা হয়। স্থায়ী অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে এলাকার কিছু জনগণ হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করলে টিআরএম কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। হাইকোর্টের স্থগিত আদেশ প্রত্যাহার হলে ২০১৫ সালের ১১ জুলাই আংশিক সেকশনে ৭.৮১ (৩৯.৫২%) একর ভূমিতে পাউবো বাঁধ কেটে সংযোগ খাল চালু করে টিআরএম কার্যক্রম শুরু করলে সংযোগ খালের দুইপাশে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এই ভাঙ্গন রোধের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হলেও নি¤œমানের বাঁধের কারণে প্রায়ই বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তবে পাখিমারা বিলে টিআরএম চালু হওয়ায় গত ১ বছরে কপোতাক্ষ নদের বালিয়া হতে পাইকগাছার শিববাড়ী মোহনা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কপোতাক্ষ নদীর বুকে জমে থাকা পলি পরিকল্পনা অনুযায়ী খনন করে সম্পূর্ণভাবে অপসারণ না করায় কপোতাক্ষ অববাহিকায় এখনও জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হয়নি। ফলে এ জনপদে জলাবদ্ধতার কারণে ভোগান্তি নিরসন হয়নি। পাশাপাশি পাখিমারা বিলের জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জন্য ১০.২০ কিলোমিটার গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধটি (পেরিফেরিয়াল বাঁধ) যথাযথভাবে তৈরি না হওয়ার কারণে বাঁধ ভেঙ্গে বা জোয়ারের পানি উপচিয়ে মাঝে মধ্যে পাশের গ্রাম প্লাবিত হয়ে জনভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া বাঁধের অধিকাংশ আউটলেট পাইপগুলো সঠিকভাবে স্থাপন না করায় তা দিয়ে জোয়ারাধারের বাইরের পানি নিষ্কাশিত না হয়ে বরং জোয়ারাধারের পানি গ্রাম এলাকায় প্রবেশ করছে। এসব সমস্যার কারণে বর্ষা মৌসুমে এলাকার ফসলি জমি, মাছের ঘের, রাস্তা ও বাড়ি-ঘর প্লাবিত হচ্ছে। আইডব্লিউএমের সমীক্ষা ও প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুসারে পাখিমারা বিলের জোয়ারাধারের জন্য ১৫৬১.৯৬ একর জমি হুকুম দখল করা হয় এবং পরবর্তীতে স্থানীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রতি বছর একর প্রতি ৪৩,১২৭.০০ টাকা ফসলের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়। ২০১১ সালে প্রকল্প কার্যক্রম শুরু হলেও প্রায় ৬ বছর পরও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে মাত্র ১ বছরের। পরের বছরের ক্ষতিপূরণ কবে দেয়া হবে তারও কোন পরিকল্পনা করা হয়নি। তবে জেলা প্রশাসক জানান, দ্বিতীয় বছরের জন্য জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকার বরাদ্দ মিলেছে। তবে অধিগ্রহণ করা জমির মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে পদ্ধতিগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ফসলের ক্ষতিপূরণ প্রদানের সমস্যাটি টিআরএম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাশাপাশি বিলে পলি ভরাটের বিপরীতে অসংখ্য নেট-পাটা দিয়ে বাধাগ্রস্ত করায় টিআরএমের সফলতা নিয়েও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। টিআরএম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি যেমন সবচেয়ে বড় সমস্যা তেমনি সুষ্ঠুভাবে টিআরএম বিলে পলি ভরাট না হওয়াটাও একটা বড় সমস্যা। প্রকল্প কার্যক্রম ইতোমধ্যে প্রায় ৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও জমির মালিকরা ৬ বছরের পরিবর্তে শুধু ১ বছরের জন্য ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছে। বাকি টাকা কখন, কিভাবে পাবে এ নিয়ে ইতোমধ্যে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি টিআরএমভুক্ত কৃষি জমির ওপর শুধু জমির মালিকদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল নয়। ভূমিহীন কৃষক, বিধবা বা দরিদ্র মহিলা, ভূমিহীন মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকাও এই বিলের ওপর নির্ভরশীল। অথচ জোয়ারাধার প্রকল্পে সরকার জমির মালিকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলেও এসব মানুষের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। জোয়ারাধার বাস্তবায়নের ফলে এ সমস্ত দরিদ্র মানুষেরা জীবিকার প্রয়োজনে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে অভিবাসিত হচ্ছে। এছাড়া নক্সা অনুযায়ী পেরিফেরিয়াল বাঁধ তৈরি না হওয়ায় অস্থায়ীভাবে হুকুম দখলকৃত জমির বাইরের ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক জমির ওপর দিয়ে এই বাঁধ নির্মিত হয়েছে। পাখিমারা বিলের টিআরএমভুক্ত সংযোগ খালের জন্য প্রকল্পের শুরুতে ১৯.৭৬ একর জমি স্থায়ীভাবে অধিগ্রহণ করে সংযোগ খাল খনন করা হলেও অধিগ্রহণের প্রায় ৬ বছর পরও জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও পরিশোধ না হওয়া, অস্থায়ী অধিগ্রহণের জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ না হওয়া ও সুষ্ঠু বিল ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় টিআরএম প্রকল্প ও কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়েও এলাকার মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
×